বাংলাদেশে ডাক বিভাগ (বিডিপিও) জাতীয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা যা দেশের ডাক সংক্রান্ত সকল পরিষেবা প্রদান করে। এটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (ডিওটি) অধীনে কাজ করে। এটি বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তর। এই বিভাগটি প্রধানতঃ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলিকরণ , পত্র যোগাযোগ, সরকারি অফিস-আদালতের পত্র যোগাযোগ, বাণিজ্যিক ডাক সেবা, মূল্য অধিকরণ, ভ্যালু পেয়েবল (ভিপি) সেবা, বীমা সেবা, বাণিজ্যিক পার্সেল সেবা, মানি অর্ডার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান করে। বিডিপিওর সদর দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত এবং এটির দেশব্যাপী একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে । বাংলাদেশের ডাক বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম সেবা সংস্থা হিসাবে কাজ করে এবং দেশের মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের শ্লোগান- সেবাই আদর্শ ।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ইতিহাস
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। শেরশাহের শাসনামলে ১৭৭৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ডাক সার্ভিস চালু হয় । শেরশাহ ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিলেন । ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের দেওয়ানি লাভের পর শেরশাহের হাত ধরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৭৪ সালে 'বঙ্গীয় ডাক বিভাগ' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এই বিভাগ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে সর্বপ্রথম ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হয় মিশরে, ২০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ।
⮚ প্রাথমিক যুগ:
- ব্রিটিশ শাসনামলে 'বঙ্গীয় ডাক বিভাগ' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৭৪ সালে।
- ঢাকায় প্রথম ডাকঘর স্থাপিত হয় ১৭৯৩ সালে।
- ১৮৫৪ সালে 'ইউনিফর্ম পোস্টেজ' ব্যবস্থা চালু করা হয়।
- ১৮৭৬ সালে 'পোস্টাল অর্ডার' ব্যবস্থা চালু করা হয়।
- ১৮৮০ সালে 'টেলিগ্রাফ' ব্যবস্থা চালু করা হয়।
⮚ বিংশ শতাব্দী:
- ১৯০৭ সালে 'মোবাইল পোস্ট অফিস' চালু করা হয়।
- ১৯১১ সালে 'পোস্টাল সেভিংস ব্যাংক' চালু করা হয়।
- ১৯৪৭ সালে 'পাকিস্তান পোস্ট অফিস' এর অধীনে আসে।
- ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর 'বাংলাদেশ ডাক বিভাগ' প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৯৭২ সালে 'ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন' (ইউপিইউ)-এর সদস্যপদ লাভ করে।
⮚ স্বাধীনতার পর:
- স্বাধীনতার পর ডাক বিভাগের দ্রুত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটে।
- দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাকঘর স্থাপন করা হয়।
- নতুন নতুন সেবা চালু করা হয়, যেমন:
'এমএস' (মনি অর্ডার)
'ইএমএস' (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস)
'স্পিড পোস্ট'
'কুরিয়ার সার্ভিস'
- ডাক বিভাগ ডিজিটাল সেবার দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে।
- বাংলাদেশ পোস্ট' অ্যাপ চালু করা হয়েছে।
- ডিজিটাল লেনদেন নগদ চালু করা হয়েছে ।
⮚ বর্তমান অবস্থা:
- বর্তমানে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান।
- দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে ডাক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ডাক বিভাগ দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সম্পর্কে তথ্য
- বিশ্বে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় : ইংল্যান্ডে
- বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিটের নাম- : পেনিব্লাক (১৮৩০ সালে স্যার বোগান্ড হিল এটি প্রকাশ করেন)
- ডাকটিকিটে দেশের নাম লেখা থাকে না : ইংল্যান্ডের
- ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় : ১৮৭৫ সালে
- বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় : ২৯ জুলাই, ১৯৭১ (মুজিবনগর সরকার প্রকাশ করে) একসঙ্গে ৮টি ডাকটিকিট চালু হয়
- বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিটে ছিল- : বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি
- বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিটের ডিজাইনার : বিমান মল্লিক
- বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিটের মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান : ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস
- স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
- স্বাধীনতার পর প্রকাশিত প্রথম ডাকটিকিটে ছিল : শহীদ মিনারের ছবি
- স্বাধীনতার পর প্রকাশিত প্রথম ডাকটিকিটের ডিজাইনার : রিপ্টি চিন্টানিশ
- স্বাধীনতার পর প্রকাশিত প্রথম স্মারক ডাক টিকিটের ডিজাইনার ছিলেন : বিপি চিতনিশ
- স্বাধীনতার পর প্রকাশিত প্রথম ডাকটিকিটের মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান : ইন্ডিয়া সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস
- বর্তমানে ডাকটিকিট মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান : দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন, গাজীপুর
- সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের স্মরণে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে
- স্বাধীনতার পর প্রথম পোস্টকার্ড প্রকাশিত হয় : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭২
- বাংলাদেশে পোস্টকোড চালু হয় : ১৯৮৬ সালে
- বাংলাদেশে প্রধান ডাকঘর : জি.পি.ও
- বাংলাদেশ পোস্ট অফিস জাদুঘর অবস্থিত : ঢাকার জি.পি.ও (পুরানা পল্টন) -এ
- বাংলাদেশের একমাত্র পোস্টাল একাডেমি অবস্থিত : রাজশাহীতে
- বাংলাদেশে প্রথম ডাকঘর স্থাপিত হয় : চুয়াডাঙ্গায়
- বাংলাদেশে বর্তমানে ডাকঘর আছে : ৯৮৮৬ টি (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০)
- বাংলাদেশের সাথে ডাকযোগাযোগ নেই : ইসরাইলের
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ
- বাংলাদেশ ডাক বিভাগের শ্লোগান : সেবাই আদর্শ
- বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মনোগ্রাম : একটি ধাবমান রানারের কাঁধে ঝোলানো চিঠির ব্যাগ, হাতে একটি বল্লম এবং এর মাথায় একটি প্রজ্জলিত লণ্ঠন ।
- বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সদর দপ্তর : ঢাকায়
- বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা : ডাক প্রবাহ
- ডাক বিভাগের সর্বোচ্চ পদের নাম : পোস্ট মাস্টার জেনারেল
- দেশে জিপিও চারটি : ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী
- বাংলাদেশ ডাক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক : তরুন কান্তি সিকদার
⮚ e-post : ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট বাংলাদেশে e-post চালু করা হয়। এ সময় ইলেক্ট্রনিক মেইল সার্ভিস নামে e-post টি দেশের পোস্ট অফিসগুলোকে পরিচয় করে দেওয়া হয়।
⮚ GEP : একটি আভ্যন্তরীন বিশেষায়িত মেইল সার্ভিস। অধিক নিরাপদ এবং দ্রুতগতির একটি পোষ্টীল সেবার নাম GEP। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত এই সেবাটি বর্তমানে ডাকা শহরের সকল পোস্ট অফিসসহ ৪২৯টি পোষ্ট অফিসে চালু আছে।
⮚ ডাক জাদুঘর : ১৯৬৬ সালের ৯ অক্টোবর দেশের প্রথম পোস্টাল মিউজিয়াম হিসেবে ঢাকার জিপিওতে চালু হয় এবং পরে তা ১৯৮০ সালের ৩০ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ পোস্টাল মিউজিয়াম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে, দেশের চারটি জিপিওর মধ্যে অবশিষ্ট তিনটি চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে অবস্থিত। তাছাড়া দেশের একমাত্র পোস্টাল একাডেমিটি রাজশাহীতে অবস্থিত।
⮚ ডাক বিভাগের ডিজিটাল সেবা: নগদ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ চালু করেছে 'নগদ' নামে ডিজিটাল আর্থিক সেবা। এর মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এর মতই টাকা পাঠানো, ব্যালেন্স রিচার্জ, বিল পরিশোধ করা যায়। ২০১০ সালে শুরু হওয়া বাংলাদেশ ডাক বিভাগের 'পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিস' ছিল দেশের প্রথম ডিজিটাল আর্থিক সেবা।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অর্জন
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের লক্ষ্য হল দেশের সকল মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যের, নির্ভরযোগ্য এবং মানসম্পন্ন ডাক সেবা প্রদান করা। বিডিপিও ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করছে এবং এর মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা অনলাইনে অফার করছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মধ্যে রয়েছে:
- ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের (ইউপিইউ) সদস্যপদ অর্জন (১৯৭২)
- এশিয়া-প্যাসিফিক পোস্টাল ইউনিয়নের (এপিপিইউ) সদস্যপদ অর্জন (১৯৮১)
- আন্তর্জাতিক ডাক সেবাগুলির স্বয়ংক্রিয়করণ (১৯৯০)
- ইএমএস সেবার চালুকরণ (১৯৯৩)
- স্পিড পোস্ট সেবার চালুকরণ (১৯৯৯)
- মোবাইল অ্যাপের চালুকরণ (২০১৭)
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সরকার এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রদান করে।