অনেকগুলো অ্যামাইনো এসিড পেপটাইড বন্ড দ্বারা যুক্ত হয়ে পলিপেপটাইড গঠন করে। এক বা একাধিক পলিপেপটাইড সম্বলিত বৃহদাকার সক্রিয় জৈব রাসায়নিক পদার্থকে প্রোটিন/ আমিষ বলে। আমিষ আমাদের দেহের গঠন উপাদান। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও সালফারের সমন্বয়ে আমিষ গঠিত। আমিষে ১৬% নাইট্রোজেন থাকে। নাইট্রোজেন এবং শেষোক্ত উপাদানগুলোর উপস্থিতির কারণে আমিষের গুরুত্ব শর্করা ও স্নেহ পদার্থ থেকে আলাদা। শুধু আমিষজাতীয় খাদ্যই শরীরে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে বলে পুষ্টিবিজ্ঞানে আমিষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমিষ হলো অ্যামাইনো এসিডের একটি জটিল যৌগ। পরিপাক প্রক্রিয়া দ্বারা এটি দেহে শোষণ উপযোগী অ্যামাইনো এসিডে পরিণত হয়। এ পর্যন্ত প্রকৃতিজাত দ্রব্যে ২২ প্রকার অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমরা বাংলা বা ইংরেজি বর্ণমালাগুলো সাজিয়ে যেমন অসংখ্য শব্দ গঠন করতে পারি, তেমনি ২২টি অ্যামাইনো এসিড বিভিন্ন সংখ্যায়, বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে মিলিত হয়ে আমিষের উৎপত্তি ঘটায়। এ কারণে মাছ, দুধ, মাংস ইত্যাদি খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের তারতম্য দেখা যায়।
অ্যামাইনো এসিড
অ্যামাইনো এসিড (Amino acid) হলো প্রোটিনের মূল গাঠনিক একক। প্রোটিন মূলত অ্যামাইনো এসিডের পলিমার । জৈব এসিডের এক বা একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু অ্যামিনো মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ফলে উৎপন্ন জৈব এসিডকে অ্যামিনো এসিড বলে। অর্থাৎ প্রোটিন বা আমিষকে ভাঙলে বা বিশ্লেষণ করলে যেসব উপাদান পাওয়া যায় তাদের অ্যামিনো এসিড বলে। প্রতিটি অ্যামাইনো অ্যাসিডে উপস্থিত মৌলগুলি হলো কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O), এবং নাইট্রোজেন (N) । এ পর্যন্ত ২৮টি অ্যামাইনো এসিড আবিষ্কৃত হয়েছে । প্রোটিন তৈরীতে ২০টি অ্যামাইনো এসিড অংশ গ্রহণ করে । পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির শরীরে Amino Acid-এর সংখ্যা ২০টি। নন-প্রোটিন অ্যামাইনো এসিডের উদাহরণ- অরনিথিন, সাইট্রলিন, হেমোসেরিন ইত্যাদি।
দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও নাইট্রোজেনের সমতা রক্ষার জন্য অ্যামাইনো এসিড অত্যন্ত প্রয়োজন। কিছু কিছু অ্যামাইনো এসিডকে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড বলে। অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড দেহে তৈরি হয় না। খাদ্য থেকে এ অ্যামাইনো এসিডগুলো সংগ্রহ করতে হয়। অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড ৯ টি। যথাঃ লাইসিন, লিউসিন, আইসোলিউসিন, ভ্যালিন, মিথিওনিন, থ্রিওনিন, ট্রিপটোফ্যান, ফিনাইল অ্যালানিন, হিস্টিডিন। প্রাণীজ প্রোটিনে এই অপরিহার্য অ্যামাইনো এসিডগুলো থাকে বলে এর পুষ্টিমূল্য বেশি। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনে এরা থাকেনা বলে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের পুষ্টিমূল্য কম। অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের অভাব ঘটলে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- বমি বমি ভাব, মূত্রে জৈব এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নাইট্রোজেনের ভারসাম্য বজায় না থাকা ইত্যাদি।
আমিষের উৎস
মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, শিমের বীচি, শুঁটকি মাছ, চিনাবাদাম ইত্যাদি থেকে আমরা আমিষ পাই। উৎস অনুযায়ী আমিষ দুই ধরনের: প্রাণিজ আমিষ এবং উদ্ভিজ্জ আমিষ।
প্রাণিজ আমিষ: যে আমিষগুলো প্রাণিজগৎ থেকে পাওয়া যায় তাদেরকে প্রাণিজ আমিষ বলে। যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, পনির, ছানা, কলিজা বা যকৃৎ ইত্যাদি প্রাণিজ আমিষ। এসব খাদ্যে দেহের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়।
উদ্ভিজ্জ আমিষ: উদ্ভিদ জগৎ থেকে প্রাপ্ত আমিষকে উদ্ভিজ্জ আমিষ বলে। যেমন- ডাল, চিনাবাদাম, শিমের বীচি , সয়াবিন ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ আমিষ। একসময় ধারণা করা হতো এগুলো প্রাণিজ আমিষের তুলনায় কম পুষ্টিকর, কারণ উদ্ভিজ্জ আমিষে প্রয়োজনীয় সব কয়টি অ্যামাইনো এসিড থাকে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্ভিজ আমিষ প্রাণিজ আমিষের মতোই সকল অ্যামাইনো এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে ধারণ করে।
অনেক সময়, দুই বা ততোধিক উদ্ভিজ্জ আমিষ একত্রে রান্না করা যায়। কিন্তু এতে অ্যামাইনো এসিডের অনুপাতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না।
দেহে শোষণ
খাদ্যের হজম প্রক্রিয়াকে পরিপাক বলে। খাদ্য গ্রহণের পর খাদ্য উপাদানের বৃহৎ ও জটিল অণুগুলো ক্ষুদ্র ও সরল অনুপাতে রূপান্তরিত হয়ে দেহে শোষিত হয়ে রক্তস্রোতে মিশে যায় এবং শরীরে পুষ্টি সাধন করে। ট্রিপসিন আমিষ জাতীয় খাদ্য হজমে সাহায্য করে। আংশিক পরিপাককৃত আমিষ ক্ষুদ্রান্ত্রে ট্রিপসিনের সাহায্যে ভেঙ্গে অ্যামাইনো এসিড ও সরল পেপটাইডে পণিত হয়।
সব আমিষ দেহে সমান পরিমাণে শোষিত হয় না। আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করার পর এর শতকরা যত ভাগ অন্ত্র থেকে দেহে শোষিত হয় তত ভাগকে সেই আমিষের সহজপাচ্যতার গুণক ধরা হয়। সহজপাচ্যতার উপর আমিষের পুষ্টিমান নির্ভর করে। যে আমিষ শতকরা ১০০ ভাগই দেহে শোষিত হয় এবং দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণে কাজ করে তার সহজপাচ্যতার গুণক ১। এক্ষেত্রে আমিষ গ্রহণ এবং দেহের ধারণের পরিমাণ সমান। সহজ অর্থে বলতে গেলে যতটুকু আমিষ গ্রহণ করা হয় তার সম্পূর্ণটাই দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণে কাজ করে। আর তা না হলে সহজপাচ্যতার গুণক ১ হতে কম হয়। মায়ের দুধ ও ডিমের আমিষের সহজপাচ্যতার গুণক ১। অন্যান্য সব আমিষেরই সহজপাচ্যতার গুণক ১ হতে কম।
আমিষের অভাবজনিত রোগ
খাদ্যে পরিমিত প্রয়োজনীয় জৈব আমিষ বা মিশ্র আমিষ না থাকলে শিশুর দেহে আমিষের অভাবজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগলে দেহের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শিশুদের কোয়াশিয়রকর ও মেরাসমাস রোগ দেখা দেয়।
কোয়াশিয়রকর রোগের লক্ষণ
- শিশুদের খাওয়ায় অরুচি হয়।
- পেশি শীর্ণ ও দুর্বল হতে থাকে, চামড়া এবং চুলের মসৃণতা ও রং নষ্ট হয়ে যায়।
- ডায়রিয়া রোগ হয়, শরীরে পানি আসে।
- পেট বড় হয়।
উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারা এ রোগ নিরাময় হলেও দেহে মানসিক স্থবিরতা আসে। কোয়াশিয়রকর রোগ মারাত্মক হলে শিশুর মৃত্যু ও হতে পারে।
মেরাসমাস রোগের লক্ষণ
- আমিষ ও ক্যালরি উভয়েরই অভাব ঘটে, ফলে দেহের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
- শরীর ক্ষীণ হয়ে অস্থিচর্মসার হয়।
- চামড়া বা ত্বক খসখসে হয়ে ঝুলে পড়ে।
- শরীরের ওজন হ্রাস পায়।
শিশুদের জন্য এরূপ অবস্থা বিপজ্জনক। এছাড়া প্রোটিনের অভাবে বয়স্কদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
তথ্য কণিকা
- কোলাজেন: এক ধরনের প্রোটিন।
- প্রোটিনের প্রধান কাজঃ দেহের বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণ করে।
- Natural Protein-এর কোড নাম: Protein P-49।
- দীর্ঘদিন একটানা খেসারি ডাল খেলে কোন রোগ হতে পারে: খেসারি ডালে BOAA নামক এক ধরনের অ্যামাইনো এসিড থাকে যা ' ল্যাথারাইজম' রোগের জন্য দায়ী।
- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন এ চারটি মৌলের সমন্বয়ে আমিষ তৈরি হয়।
- প্রাণী দেহের গঠন প্রোটিন অপরিহার্য। দেহকোষের বেশিরভাগই প্রোটিন দিয়ে তৈরি।
- দেহের হাড়, পেশি, লোম, পাখির পালক, নখ, পশুর সিং এগুলো সবই প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয়।
- প্রাণীদেহের ওজনের প্রায় ৫০% হচ্ছে প্রোটিন।
- ডিমের সাদা অংশে অ্যালবুমিন পাওয়া যায়।
- অ্যান্টিবডি উপাদানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে- আমিষ।
- হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে- আমিষ।
- মাতৃদুগ্ধ তৈরি করে- আমিষ।