মেঘ বলতে পৃথিবী অথবা অন্য কোনো গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদির বায়ুমন্ডলে দৃশ্যমান ভরের ক্ষুদ্র তরল ফোঁটা, হিমায়িত স্ফটিক, অথবা জলকণার সমষ্টিকে বোঝায়। মূলত বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান জলীয়বাষ্পের ঘনীভবন প্রক্রিয়াই হলো মেঘ । পৃথিবীতে, বাতাসের স্যাচুরেশনের ফলে মেঘ তৈরি হয় । মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে মেঘ বৃষ্টিরুপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় । ভূপৃষ্ঠের নিকটতম স্তর ট্রপোস্ফিয়ারে মেঘের উৎপত্তি হয় । লিউক হাওয়ার্ড নামের বিশেষজ্ঞ ১৮০৩ সালে (বাংলা উইকিপিডিয়ায় ১৮০২ বলা হয়েছে) প্রথম মেঘের শ্রেণীবিভাগ করেন। ল্যাটিন ভাষায় তিনিই বিভিন্ন মেঘের নামকরণ করেন। সিরাস কিউমুলাস, নিম্বাস এবং স্ট্রেটাস নামগুলি তাঁরই দেওয়া।
মেঘের শ্রেণীবিভাগ
উচ্চতা অনুসারে মেঘকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যথা- (১) উঁচু মেঘ (High cloud). (২) মধ্যম উঁচু মেঘ (Medium high) ও (৩) নিচু মেঘ (Low cloud)। আবার মেঘের আকৃতি ও চেহারা অনুযায়ী এদের সিরাস, কিউমুলাস ও ট্রেটাস - এ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা করা যায়। পালক বা আঁশের ন্যায় মেঘকে সিরাস, ভেজা তুলার স্তুপের ন্যায় প্রায় গোলাকার মেঘকে কিউমুলাস এবং স্তরে স্তরে সজ্জিত মেঘকে স্ট্রেটাস বলে। এছাড়া নিম্বাস (Nimbus) নামে বৈশিষ্ট্যবিহীন কালো বর্ণের মেঘও দেখা যায়।
উচ্চতার উপর ভিত্তি করে মেঘের শ্রেণীবিভাগ : WMO এর অন্তর্গত International Clouds Atlas মেঘ কে উচ্চতা, আকৃতি ও গঠনের ওপর ভিত্তি করে ১০ টি প্রধান ভাগে ভাগ করে। এই ১০ প্রকারের মেঘ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হল।
উঁচু স্তরের মেঘ
- ১. সিরাস মেঘ- অধিক উচ্চতায় স্বচ্ছ সাদা রঙের পাখির পালক বা চুলের মতো মেঘ গুলিকে সিরাস মেঘ বলা হয়। এই মেঘে সুক্ষ্ন বরফ কুচির অবস্থান থাকে এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত্রের সময় মেঘ গুলি দেখতে চমৎকার রকমের সুন্দর লাগে। এই মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হয় না।
- ২. সিরো-কিউমুলাস মেঘ- মেঘ পাতলা সাদা রঙের মেঘ যা আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করে মোকা থোকা ভাবে অবস্থান করে। এই ধরণের মেঘ খুব কম পরিমানে আকাশে দেখা যায়। সিরো কিউমুলাস মেঘ আকাশে ম্যাকারেল মাছের কাঁটার মতো সারি বদ্ধ ভাবে ছড়িয়ে থাকে বলে, একে ম্যাকারেল মেঘ বলা হয়।
- ৩. সিরো-স্ট্যাটাস মেঘ- এটি এক ধরণের স্বচ্ছ মেঘ যা সূর্য ও চাঁদের চারিদিকে হোলো বা বর্ণবলয় সৃষ্টি করে। এই মেঘে আকাশে রামধনু দেখা যায়। এই মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্য ও চাঁদ কে উজ্জল মন্ডল এর মত দেখায়।
মধ্যবর্তী স্তরের মেঘ
- ৪. অল্টো কিউমুলাস মেঘ- সাদা ও ধূসর রঙের এই মেঘ হোলো বা আলোক প্রভার সৃষ্টি করে না। অল্টো কিউমুলাস মেঘের গোলাকার গুচ্ছে কে পশম মেঘ বলা হয়। এই মেঘ গুলি আকাশে তরঙ্গের আকারে বা সমান্তরাল সারির মতো অবস্থান করে। অল্টো কিউমুলাস মেঘ প্রায়শই গ্রীষ্মের সকালে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় দেখতে পাওয়া যায়। তবে যেদিন বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে, এই মেঘ সেদিন সকালে দেখতে পাওয়া যায়। এই মেঘ অনেক ক্ষেত্রে শীতল তাপমাত্রা সূচনা সংকেত দেয়। এই মেঘ বায়ুমন্ডলের ৭০০০-২৩,০০০ ফুট উচ্চতায় দেখতে পাওয়া যায়।
- ৫. অল্টো স্ট্র্যাটাস মেঘ- ধূসর বা নীলচে রঙের স্তুরীভূত এই মেঘ চাদরের মতো বিস্তৃত থাকে। আকাশের এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই মেঘ ছড়িয়ে থাকে। এই ধরণের মেঘ থেকে এক নাগাড়ে অনেক সময় ধরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বা তুষার পাত হয়ে থাকে। এই মেঘ বায়ুমন্ডলের ৭০০০-২৩,০০০ ফুট উচ্চতায় দেখতে পাওয়া যায়। এই মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্যকে অনুজ্জ্বল দেখায়। সাধারণত এই মেঘে একটানা বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়। ঝড় কিংবা তুষারপাতের আগে এইরূপ মেঘ দেখতে পাওয়া যায়।
নিম্ন স্তরীয় মেঘ
- ৬. নিম্বো স্ট্যাটাস মেঘ- ধূসর বা কালো রঙের মেঘ। নিম্ন স্তরের এই নিম্বো স্ট্যাটাস মেঘ প্রচুর বৃষ্টিপাত বা তুষারপাত হয়ে থাকে। কিন্তু এই ধরণের মেঘ থেকে কখনো বিদ্যুৎ, বজ্রপাত ও শিলা বৃষ্টি হয় না। নিম্বো স্ট্যাটাস মেঘকে rain cloud বলা হয়। এই মেঘ নিন্ম ও মাঝারি স্তর থেকে উপরের দিকে প্রসারিত হয়। এই মেঘ বায়ুমন্ডলের ২০০০-১৮,০০০ ফুট উচ্চতায় দেখতে পাওয়া যায়।
- ৭. স্ট্র্যাটো কিউমুলাস মেঘ- ২.৫ কিমি থেকে ৩ কিমি অথবা ২০০০-৭০০০ ফুট উচ্চতায় যে সাদা রঙের মেঘ দেখা যায়। এই ধরণের মেঘের উপস্থিতি পরিষ্কার আবহাওয়াকে নির্দেশ করে কিন্তু মাঝে মধ্যে এই ধরণের মেঘ থেকে বৃষ্টি বা তুষারপাত হয়ে থাকে। এই মেঘ ধূসর রঙের, দেখলে মনে হবে অনেকটা স্তুপের মত স্তরে স্তরে সাজানো আছে। অনেক সময় দেখে মনে হয় মেঘের স্তরগুলো যেন গড়িয়ে চলেছে তাই এই মেঘের অপর নাম 'Bumpy Cloud'।
- ৮. স্ট্র্যাটাস মেঘ - ঘন কুয়াশার মতো এই মেঘ গভীর ধূসর রঙের মেঘ, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে খুব স্বল্প উচ্চতায় অবস্থান করে। পাহাড়ের উঁচু অংশে এই মেঘ জমলে পর্বতারোহী ও বিমান চালকদের পক্ষে খুব অসুবিধা হয়ে পড়ে। এই মেঘ ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় দেখতে পাওয়া যায়। মেঘলা দিনে এই মেঘ দেখতে পাওয়া যায়। এই মেঘে হালকা বৃষ্টি হয়ে থাকে।
- ৯. কিউমুলাস মেঘ- কিউমুলাস শব্দের অর্থ হল স্তুপ। পুরু, ঘন এই মেঘের উলম্ব বিস্তার দেখা যায়। মেঘের উপরিভাগ অনেকটা বৃত্তাকার বা ফুলকপির মতো দেখতে হয়। টাওয়ার বা চূড়ার মতো উল্লম্ব বিস্তৃত ঘন মেঘ কে কিউমুলাস মেঘ বলে। এই মেঘ গুলির ওপরের অংশ ফুলকপির মতো বিস্তৃত হয়। এই মেঘে পরিচলন স্রোতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই মেঘ স্থলভাগের ওপর দিনের বেলা দেখা যায়। এই মেঘ বায়ুমন্ডলে ১০০০-৭০০০ ফুট উচ্চতায় দেখা যায়।
- ১০. কিউমুলোনিম্বাস - নিম্ন, মাঝারি ও উচ্চস্তরের মেঘগুলির মধ্যে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ অন্যতম। পাহাড় বা বড়ো টাওয়ারের মতো উল্লম্ব বিস্তৃত এই ঘন কালো জলীয় বাষ্প পূর্ণ এই মেঘ থেকে ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই মেঘের ফলে বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমক ও শিলা বৃষ্টি হয়ে থাকে। এই কিউমুলোনিম্বাস মেঘ কে thunder cloud বলা হয়ে থাকে।