বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক ও বিদ্রূপাত্মক প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী। তীক্ষ্ণ মননশীলতা, বাকচাতুর্যের চমৎকারিত্ব এবং বুদ্ধির অসিচালনা ছিল তাঁর ভাষাগত বিশেষত্ব। তিনি ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ বাংলা প্রথম সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেন । তিনি রবীন্দ্রনাথকে বাংলা গদ্যে চলিত রীতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন । তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার। তিনি ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন । তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল বীরবল , নীললোহিত।
জন্ম ও পরিচয়
প্রমথ চৌধুরী ৭ আগস্ট, ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। । স্থানীয় জমিদার বংশে তাঁর জন্ম, তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী এবং মাতার নাম মগ্নময়ী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সাথে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝির জামাতা। লেখক আশুতোষ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪৪) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগিনী প্রতিভা দেবীর সহিত আশুতোষ চৌধুরী বিবাহ হয়।
শিক্ষাজীবন
প্রমথ চৌধুরী খুবই প্রতিভাবান ছিলেন । তাই তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ.এ. পাস করেন। তিনি ১৮৮৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে বি.এ. অনার্স কমপ্লিট করেন । অত:পর ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন । তিনি ১৮৯৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত গমন করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথেই ব্যারিস্টারি পাশ করেন। তিনি ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন ।
কর্মজীবন
বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ফিরে আসার পর ব্যারিস্টারিতে যোগদান না করে কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন । অত:পর কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন । তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ও ছিলেন। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন । ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার অব্যবহিত পরেই অন্যান্য পেশার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চায় ও মনোনিবেশ করেন।
বিশেষত্ব
তাকে বলা হয় বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক ও বিদ্রূপাত্মক প্রাবন্ধিক । বাংলা কাব্য সাহিত্যে তিনিই প্রথম ইতালীয় সনেটের প্রবর্তন করেন। তিনি সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতি প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম হালখাতা গদ্য/প্রবন্ধ রচনায় প্রথম চলিত রীতির প্রয়োগ ঘটান।
সাহিত্যকর্ম
প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বেশী বিখ্যাত। প্রমথ চৌধুরীর প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব ১৮৯৩ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চলিত রীতিতে তার প্রথম গদ্যরচনা হালখাতা । যেটি ভারতী পত্রিকায় ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । বাজারের অধিকাংশ বইয়ে লেখা যে, প্রমথ চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘বীরবলের হালখাতা । প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ‘হালখাতা। কারণ, ‘বীরবলের হালখাতা প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে আর ‘হালখাতা' গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। [ সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান] প্রমথ চৌধুরীর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম ছাড়া তিনি অন্য কোনো দিক থেকে মৌখিক ভাষার বিশেষ অনুকরণ করেন নি । ভাষার অনাবশ্যক মারপ্যাঁচ বাচনভঙ্গির অকারণ তির্যকতা ও অলংকারের চাকচিক্য তাঁর রচনায় কোথাও কোথাও চলিত ভাষাকে সাধুভাষার চেয়েও দুর্বোধ্য করে তুলেছে । সেজন্য প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘প্রমথ চৌধুরীর রচনায় ব্যারিস্টারির প্যাঁচ আছে ।
প্রবন্ধ গ্রন্থ
- তেল-নুন-লাকড়ী (১৯০৬)
- বীরবলের হালখাতা (১৯১৬)
- নানাকথা (১৯১৯)
- আমাদের শিক্ষা (১৯২০)
- রায়তের কথা (১৯১৯)
- নানাচর্চা (১৯৩২)
- আত্মকথা (১৯৪৬)
- প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৫২ ১ম খণ্ড ও ১৯৫৩ ২য় খণ্ড)
- ভাষার কথা
গল্পগ্রন্থ
চার-ইয়ারী কথা (১৯১৬) : চারবন্ধুর প্রেমের কাহিনি নিয়ে প্রমথ চৌধুরী রচনা করেন বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ চার ইয়ারি কথা । চারবন্ধুর প্রত্যেকটি প্রেমই অভিশপ্ত। এদের নায়িকারা স্বর্ণকেশী ইউরোপীয়। প্রথম নায়িকা উম্মাদ, দ্বিতীয় নায়িকা চোর, তৃতীয় নায়িকা প্রতারক এবং চতুর্থ নায়িকা মৃত্যুর পর তার ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। নানাবিধ হাস্যরসাত্মক ঘটনা ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে।
- আহুতি (১৯১৯)
- নীললোহিত ও গল্পসংগ্রহ (১৯৪১)
- অনুকথা সপ্তক
- ঘোষালে ত্রিকথা
কাব্যগ্রন্থ
- সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩)
- পদচারণ (১৯১৯)
প্রবন্ধ
- যৌবনে দাও রাজটীকা
- বই পড়া
- সাহিত্যে খেলা
- ভাষার কথা
পত্রিকা সম্পাদনা
তিনি সবুজপত্র (১৯১৪), বিশ্বভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
সবুজপত্র
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ১৯১৪ সালে (বৈশাখ- ১৩২১) এর প্রথম প্রকাশ ঘটে। বাংলা গদ্যরীতির বিকাশে এই পত্রিকার গুরুত্ব অপরসীম। সাধু গদ্যরীতির পরিবর্তে চলিত গদ্যরীতি ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠায় এটির অবদান তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই পত্রিকায় লেখার সুবাদে চলিত গদ্যরীতির স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন এবং পরে তা তিনি চর্চা করেন। রবীন্দ্রনাথের কথ্য ভাষায় লেখা উপন্যাস শেষের কবিতা এ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে প্রমথ চৌধুরীর চলিত ভাষার আন্দোলন ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। প্রমথ চৌধুরী বীরবলী রীতি নামে যে মৌখিক ভাষারীতি সাহিত্যে প্রচলন করে যুগান্তর এনেছিলেন তার প্রচারের মাধ্যম ছিল এই সবুজপত্র । সাহিত্যজগতে এ পত্রিকা সবুজপত্র গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয় ।
পদক প্রাপ্তি
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করেন। উল্লেখ্য, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজ মাতার নামে এ পদক প্রবর্তন করেন ।
বিখ্যাত উক্তি
- সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। ( বই পড়া)
- ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে,
উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে। (ভাষার কথা)
মৃত্যু
তিনি ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ সালে (১৬ ভাদ্র, ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ) শান্তিনিকেতনে মারা যান ।