ধর্মমঙ্গলের উপাখ্যানের কাঠামো
গৌড়ের রাজার মহাপাত্র ছিল তাঁরই শ্যালক মহামদ। সোম ঘোষ নামের এক গোয়ালা রাজকর দিতে না পারায় মহামদের চক্রান্তে বন্দি ছিল। রাজা একদিন মৃগয়ায় যাওয়ার পথে তাকে দেখে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন পরে তাকে ত্রিষষ্ঠীর গড়ের শাসনকর্তা করে দিলেন। কর্ণসেন ছিল পূর্বেই ত্রিষষ্ঠীতে রাজকর্মচারী। সে সোম ঘোষের কর্তৃত্বে কাজ করতে থাকে। সোম ঘোষের পুত্র ইছাই ঘোষ প্রবলপ্রতাপ হয়ে কর্ণসেনকে বিতাড়িত করল। কর্ণসেন গৌড়ে আশ্রিত হলো। এদিকে ঢেকুরে গড় নির্মাণ করে স্বাধীন হয়ে গেল ইছাই। গৌড়েশ্বর তাকে দমানোর জন্যে নয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে ঢেকুর আক্রমণ করলেন। কিন্তু অজয় নদের বন্যায় তাঁর সৈন্য ভেসে যায় এবং কর্ণসেনের ছয় পুত্র নিহত হয়; ফলে ছয় বন্ধু সহমরণ বরণ করল। শোকে কর্ণসেনপত্নীও আত্মহত্যা করল, কর্ণসেন শোকে-দুঃখে মুহ্যমান হয়ে গেল। রাজা কর্ণসেনকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিলেন এবং নিজের কিশোরী শ্যালিকা রঞ্জাবতীর বিয়ে দিলেন তার সঙ্গে ভাই মহামদের অমতেই। বিয়ের পর কর্ণসেন ময়নানগরে সামন্ত নিযুক্ত হয়ে সেখানে সন্ত্রীক বাস করতে লাগল। মহামদের কামরূপ অভিযানকালেই রঞ্জাবতীর বিয়ে হয়। বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় সে কর্ণসেন ও রঞ্জাবতীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করল। বিনা নিমন্ত্রণেই একবার কর্ণসেন রঞ্জাবতীর অনুরোধে গৌড়ে আসল, ক্রুদ্ধ মহামদ 'আঁটকুড়ে' বলে বোন-ভগ্নীপতির নিন্দা করল।
‘বন্ধ্যা যার রাণী আপনি আঁটকুড়া'। অপমানিত বোন সন্তানলাভের জন্যে তুক-তাক ও ওষুধের আশ্রয় নিল। অবশেষে ধর্মঠাকুরের পূজারী রামাই পণ্ডিতের উপদেশে সে ধর্মঠাকুরের কৃপাপ্রত্যাশী হয়ে শালেভর (লোহার শলাশ্রেণির উপর ঝাঁপিয়ে পড়া) করার ব্রত গ্রহণ করল । যথাসময়ে চম্পানদীর তীরে পূজা শেষ করে রঞ্জাবতী ‘শালেভর' করল এবং মারা গেল, ‘বুকে পেটে ফুটে শাল পিঠে হল ফার/ঝলকে ঝলকে মুখে উঠে রক্তধার।' ধর্মঠাকুর তার নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে প্রাণদান করে পুত্রবর দিলেন। যথাকালে পুত্র হলে, তার নাম রাখা হলো লাউসেন। তার খেলার সাথী হিসাবে ধর্মঠাকুর আর এক শিশু দিলেন, নাম কর্পূর সেন। যথাক্রমে লাউসেন- কর্পূর সেন দুই ভাই যুদ্ধবিদ্যায় বিশারদ হয়ে উঠল। নবযৌবনে তারা গৌড়রাজের হয়ে নিজেদের নৈপুণ্য ও বীরত্ব প্রমাণ করার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠল। গৌড়ের পথে লাউসেন নরখাদক বাঘ ও কুমীর হত্যা করে জীবনের প্রথম বীরত্বকীর্তি অর্জন করল, পথে ভ্রষ্টা নারী জামত তাকে প্রলুব্ধ এবং নারীরাজ্য গোলাহাটের রানি তাকে হেঁয়ালি প্রশ্নে জব্দ ও বন্দি করতে চাইল, কিন্তু জয়ী হলো লাউসেন। এদিকে গৌড়ে মামা মহামদ লাউসেনকে জব্দ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় । গৌড়ে পৌঁছে লাউসেন এক গাছতলায় রাত্রিযাপন করছিল, মহামদের নির্দেশে এক রাজহস্তী এনে সেখানে রাখা হলো, আর প্রাতে লাউসেনকে হাতিচোর বলে বন্দি করে হাজির করা হলো রাজদরবারে অপরিচিত মেসো রাজার কাছে। সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সমর্থ হলো এবং রাজা অশ্ব উপহার দিয়ে তার হৃতমান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। স্বদেশ ময়নানগরে ফিরবার কালে নয়জন ডোম যোদ্ধা নিয়ে গেল লাউসেন, এঁদের প্রধান হচ্ছে কালু। সেই হলো ময়নানগরের সেনাপতি। তার স্ত্রীর নাম লখাই বা লক্ষ্মী। মহামদের কুপরামর্শে গৌড়রাজ লাউসেনকে কামরূপের বিদ্রোহী সামন্তকে দমন করবার নির্দেশ দিলেন। ভরা জলের ব্রহ্মপুত্র নদ পার হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব, কাজেই দুঃসাধ্য ছিল যুদ্ধ করা। কিন্তু গৌড়ের রাজমাতা প্রদত্ত মন্ত্রপূত কাটারির ও জপমালার সাহায্যে অসম্ভবও হলো সম্ভব ও সহজ। কাটারির স্পর্শে ব্রহ্মপুত্রের জল শুকাল এবং জপমালার প্রভাবে কামরূপ অধিকার করা হলো সহজ। বিজয়ী লাউসেন ফিরবার পথে কামরূপ রাজকন্যা কলিঙ্গাকে, মঙ্গলকোটের রাজকন্যা অমলাকে এবং বর্ধমানরাজকন্যা বিমলাকে পত্নীরূপে লাভ করে গৌড়ে পৌঁছল সগৌরবে ও সগর্বে।
সিমুলার রাজা হরিপালের রূপসী কন্যা কানড়াকে বিয়ে করতে চাইলেন গৌড়রাজ। অনিচ্ছুক কানড়া গৌড়েশ্বরকে একটা লোহার গণ্ডার দেখিয়ে বলল যদি রাজা এক আঘাতে ঐ গণ্ডার দ্বিখণ্ডিত করতে পারেন, তাহলেই তিনি বরমাল্য পাবেন । বৃদ্ধ রাজা ব্যর্থ হলেন । মহামদের চক্রান্তে রাজা লাউসেনকে নির্দেশ দিলেন তাঁর হয়ে গণ্ডার কাটার জন্যে । লাউসেন সহজেই সফল হলো। কানড়া তার অঙ্গীকারমতো লাউসেনকেই বরণ করল স্বামীরূপে, তাতে গৌড়েশ্বর অপ্রসন্ন হলেন তার উপর ।
মহামদ তার ষড়যন্ত্রে বারবার ব্যর্থ হয়েও ধৈর্য হারায়নি। এবার সে রাজাকে পরামর্শ দিল দুর্দান্ত বিদ্রোহী সামন্ত ইছাই ঘোষকে উৎখাত করবার জন্য লাউসেনকে পাঠাতে । রাজাদেশে লাউসেন ঢেকুরে গেল ইছাই ঘোষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। অজয় নদীর তীরে ইছাই ঘোষের বীর সেনাপতি লোহাটাবজ্জরের (লৌবজ্র) সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হলো লাউসেনের। বিজয়ী লাউসেন লোহাটাবজ্জরের ছিন্নমস্তক পাঠাল গৌড়েশ্বরের কাছে । দুষ্ট মহামদ সেটাকে লাউসেনের মায়ামস্তকে রূপান্তরিত করে পাঠাল কর্ণসেন-রঞ্জাবতীর কাছে ময়নানগরে । পুত্রের ছিন্নমস্তক দেখে পিতামাতা শোকাকুল হলো । আর লাউসেন- পত্নীরা তৈরি হলো সহমরণের জন্যে। এমন সর্বনাশকর অবস্থায় ধর্মঠাকুর হনুমানকে ছদ্মবেশী সংবাদবাহক করে পাঠালেন ময়নানগরে প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দেয়ার জন্যে ।
এদিকে ধর্মঠাকুরের বরপুষ্ট কৃপাপুষ্ট বলেই লাউসেনের যুদ্ধ চলছে পাবতীর প্রিয় ইছাই ঘোষের সঙ্গে। অবস্থাটা যেন 'কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান'। অবশেষে লাউসেনেরই হলো জয়, ইছাই বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও নিহত হলো।
মহামদ বুঝল, ধর্মঠাকুরের কৃপাপুষ্ট বলেই লাউসেন বিপন্নক্ত ও অজেয়, তাই সেও ধর্মঠাকুরের অনুগ্রহলাভের প্রয়াসী হলো ধর্মপূজা করে। কিন্তু শঠের পূজা গ্রহণ করতে ধর্মঠাকুর নারাজ। তাই তিনি অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করাতে লাগলেন গৌড়ে। বন্যায় গৌড় ডুবে যাচ্ছিল। তখন বিপন্ন গৌড়েশ্বর লাউসেনের সাহায্য চাইলেন। লাউসেন এবার দুষ্কর সাধনার সংকল্প গ্রহণ করল। ধর্মঠাকুরের তপস্যা করে সে পুবের সূর্যের পশ্চিমে উদয় ঘটানোর অঙ্গীকারে। হাকন্দে লাউসেন যখন হাকন্দ ব্রতোদযাপনে নিরত, তখন মহামদ ময়নানগরের সেনাপতি কালুডোমের সঙ্গে যড়যন্ত্র করে ময়নানগর দখল করতে গেল। লখাই, তার পুত্র, লখাইর অনুরোধে অবশেষে কালুও যুদ্ধ করে পরাজিত ও নিহত হলো, তারপর রানি কলিঙ্গা যুদ্ধে নামল ও মরল। অবশেষে রানি কানড়া ও ধমনী মহামদকে পরাজিত করে নগর রক্ষা করল।
এদিকে লাউসেন নানাভাবে হাকন্দ (হাকন্দ বা আস্কন্দ অর্থে) তপস্যা করেও সিদ্ধির আভাস পেল না, অবশেষে সামুলার পরামর্শে নিজের মাথা কেটে অগ্নিতে আহুতি দিল। এবার ধর্মঠাকুর প্রসন্ন হয়ে লাউসেনকে জিতিয়ে দিলেন এবং অমাবস্যার রাত্রে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ঘটালেন। গৌড়ের দুঃখ-বিপদ কাটল। মহামদের কুষ্ঠ হলো, পরে সে ক্ষমাও পেল। কালু-কালিঙ্গা প্রভৃতি ধর্মের কৃপায় আবার জীবন পেল। পুত্র চিত্রসেনকে রাজ্য দিয়ে লাউসেন যথাকালে স্বর্গে গেল ।