বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। এই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে বহু প্রতিভাবান পরিচালক তাদের সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পূর্বে, ঢাকা কেন্দ্রিক 'ঢালিউড'-এর মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আলোকিত হয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, পৃথ্বীরাজ চৌধুরী, খান আতাউর রহমান, আব্দুল জব্বার খান, এজে কার্দার-এর মতো কিংবদন্তি পরিচালক। স্বাধীনতার পর, বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সূচনা হয়। তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, জহির রায়হান, হুমায়ূন আহমেদ, তানভীর মোকাম্মেল, কাজী হায়াৎ, আতিকুর রহমান মঞ্জু-এর মতো দিকপাল পরিচালক বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দেন। বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রে তানিম রহমান অংশু, নঈম ইমতিয়াজ নিয়ামত, অপূর্ব রণ বিশ্বাস, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, শিহাব শাহীন, দ্বীপঙ্কর দীপন , অমিতাভ রেজা চেীধুরী , ইফতেখার আহমেদ ফাহমী -এর মতো তরুণ প্রজন্মের পরিচালকরা নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করছেন।

হীরালাল সেন

হীরালাল সেন (১৮৯৮-১৯৭৭) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি চিত্রগ্রাহক , চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, লেখক এবং প্রযোজক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। তার চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সমাজের বিভিন্ন দিক, ঐতিহাসিক ঘটনা, এবং পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। তিনি ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০৩ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'আলী বাবা ও চল্লিশ চোর' (Alibaba and the forty thieves) নির্মাণ করেন। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র। সম্ভবত: ভারতের ১ম রাজনৈতিক ছবিও তিনি বানিয়েছেন। তিনি রয়্যাল বায়োস্কোপ গঠন করেন।

ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক কুমার ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, এবং লেখক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি মানবতার, দারিদ্র্যের, শোষণের, এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি ঢাকা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অদৈত্য মল্লবর্মন রচিত উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম' এর চলচ্চিত্র রূপ দেন। ১৯৭৩ সালে 'তিতাস একটি নদীর নাম' চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। তিনি সুবর্ণরেখা চলচ্চিত্রের পরিচালক।

সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাহিরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর এবং গ্রাফিক্স নকশাবিদ। তিনি উপমহাদেশের প্রথম অস্কার বিজয়ী। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্র ফেলুদা তাঁর অমর সৃষ্টি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান। কলকাতায় জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায়।

  • চলচ্চিত্র :
    পথের পাঁচালী: চলচ্চিত্রটি লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট বিভাগে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯২), কান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার লাভ করে।
    অপরাজিত
    অপুর সংসার [এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে অপু ত্রয়ী বলা হয়]
    অশনি সংকেত
    হীরক রাজার দেশে
    চারুলতা
    গুপী গাইন বাঘা বাইন
  • পুরস্কার :
    ⮚ অস্কার
    ⮚ ডক্টরেট (Oxford University)
    ⮚ দাদাসাহেব ফালকে
    ⮚ ভারতরত্ন

জহির রায়হান

জহির রায়হান একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। তিনি ১৯৩৫ সালে ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ছাত্রবস্থাতেই তিনি মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার তাঁর সহোদর ভ্রাতা ছিলেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাঁর নিখোজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুজতে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি।

  • চলচ্চিত্র :
    কখনও আসেনি (১৯৬১): জহির রায়হানের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র।
    কাঁচের দেয়াল: নিগার পুরস্কার লাভ করে।
    সঙ্গম (১৯৬৪): পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র (উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র)।
    বাহানা (১৯৬৫): তাঁর প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র।
    জীবন থেকে নেওয়া: পাকিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক চেতনামণ্ডিত চলচ্চিত্র। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনভিত্তিক।
    Stop genocide (স্টপ জেনোসাইড): মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রামাণ্যচিত্র।
    এ স্টেট ইজ বার্ন
    সোনার কাজল
    আনোয়ারা
    বেহুলা
    দুই ভাই
    জ্বলতে সূরয নীচে
    যে নদী মরুপথে
    Liberation Fighters
    Innocent Milions
    Birth of A Nation
    Let there be light : অসমাপ্ত।
  • গল্পগ্রন্থ : সূর্যগ্রহণ (১৯৫৮): তাঁর প্রথম গ্রন্থ। সোনার হরিণ, নয়াপত্তন।
  • উপন্যাস :
    শেষ বিকালের মেয়ে (১৯৬০): প্রথম উপন্যাস। রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস।
    হাজার বছর ধরে : আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত। উপন্যাসটির জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে রচিত চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কার পায়।
    আরেক ফাল্গুন : বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত।
    বরফ গলা নদী
    আর কতদিন
    কয়েকটি মৃত্যু
    তৃষ্ণা
  • পুরস্কার :
    ⮚ বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার - ১৯৭২
    ⮚ একুশে পদক - ১৯৭৭ (মরণোত্তর)
    ⮚ স্বাধীনতা পুরস্কার - ১৯৯২ (মরণোত্তর)

তানভীর মোকাম্মেল

তানভীর মোকাম্মেল (জন্ম: ১৯৫৬) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, লেখক এবং প্রযোজক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি একজন অনন্য প্রতিভা হিসেবে পরিচিত। তার চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সমাজের নীচু তলার মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংগ্রাম, এবং স্বপ্নগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার চলচ্চিত্রগুলোতে বাস্তবতাবাদ, কবিতা, এবং সঙ্গীতের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। তার অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০০০, ২০১০, ২০১৮) সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে: 'হুলিয়া', 'স্মৃতি একাত্তর', 'নদীর নাম মধুমতি', 'অচিন পাখি', 'চিত্রা নদীর পারে', স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'লালসালু', 'লালন' 'কর্ণফুলীর কান্না' প্রভৃতি ।

'চিত্রা নদীর পারে' (১৯৯৮): ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিল, তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে।

তারেক মাসুদ

তারেক মাসুদ ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার, লেখক এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।

তারেক মাসুদ 'চলচ্চিত্র' (১৯৯৯), 'মাটির ময়না' (২০০২), 'অন্ধকারের সারা দিন' (২০০৩), 'গেরিলা' (২০০৭), 'যোদ্ধা' (২০০৮) 'কালো ছায়া' (২০০৯) 'অটোগ্রাফ' (২০১০)-এর মতো অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারার সূচনা করেন।

তার চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'মাটির ময়না' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন। তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে:

  • বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : (১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৮)
  • ফজিলুর রহমান খান চলচ্চিত্র পুরস্কার : (২০০৩)
  • সিজাফ চলচ্চিত্র পুরস্কার : (২০০৩)
  • বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পুরস্কার : (২০০৪)

তারেক মাসুদের অবদান

  • প্রামাণ্য চিত্র : 'Let there be light'
  • চলচ্চিত্র : 'মাটির ময়না' (২০০২), 'মুক্তির গান', রানওয়ে,
  • মাটির ময়না : ২০০২ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। একই বছর চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশে বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। এটি ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। এটি প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র হিসেবে 'শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র' বিভাগে অস্কারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
  • ডকুমেন্টারি : আ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড (২০০২), নারীর কথা (১৯৯৯), ইন দ্য নেইম অফ সেফিট (১৯৯৮)
  • স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ গ্রামীণ জনগণের অভিজ্ঞতা : মুক্তির কথা: ১৯৯৬ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভ্রাম্যমান একটি গানের দলের উপর পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র।
  • বাংলাদেশের কর্মজীবী শিশুদের উপর প্রামাণ্যচিত্র : ভয়েসেস অফ চিলড্রেন (১৯৯৭)
  • মানবজাতির ঐক্যের উপর এনিমেশন চলচ্চিত্র : ইউনিসন (১৯৯৪)
  • তথ্যচিত্র : আদম সুরত (১৯৮৯) : শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে নির্মিত।
  • লন্ডন প্রবাসী এক সিলেটি পরিবারের গল্পের মাধ্যমে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ : অন্তর্যাত্রা
  • :

Hasina: A Daughter's Tell বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন গল্প নিয়ে নির্মিত ডকু-ড্রামা। ৭০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এ তথ্যচিত্রের পরিচালক রেজাউর রহমান খান পিপলু। ১৫ নভেম্বর ২০১৮ তে মুক্তি পায়।

নবীনতর পূর্বতন