প্রাচীন সভ্যতা বলতে বোঝায় মানব ইতিহাসের সেই সময়কালকে যখন মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন, কৃষি, পশুপালন, লিখন পদ্ধতি, এবং জটিল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে। আনুমানিক ৫০০০ বছর পূর্বে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। এ সময় থেকে মানুষ লিখতে শুরু করে। অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতা নদীকেন্দ্রিক বা কৃষির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে। প্রাচীন সভ্যতা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- মেসোপটেমীয় সভ্যতা
- মিসরীয় সভ্যতা
- চৈনিক সভ্যতা
- সিন্ধু সভ্যতা
- ইজিয়ান সভ্যতা
- ফিনিশীয় সভ্যতা
- পারস্য সভ্যতা
- হিব্রু সভ্যতা
- গ্রীক সভ্যতা
- রোমান সভ্যতা
- মায়া সভ্যতা
- নারা সভ্যতা
আদিম মানব
প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বছর আগে মানুষ গাছের শাখা থেকে ভূমিবাসী হয়। প্রাচীন যে প্রায়-মানবের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া গেছে তারা অস্ট্রালোপিথেকাস নামে পরিচিত। এরা আফ্রিকায় বাস করত।। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ অস্ট্রালোপিথিকাস লুসির কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়। এরা দু পায়ে হাটত এবং এদের মগজ ছিল খুবই ছোট। আদি মানুষের সবচেয়ে অগ্রসর অংশটি হোমো ইরেক্টাস নামে পরিচিত। এদের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এশিয়ায় ও আফ্রিকায়। হোমো বর্গের আরেকটি প্রাগ্রসর অংশ বা প্রজাতি হচ্ছে হোমো স্যাপিয়েন্স। এদের উদ্ভব দুলাখ বছর আগে। এদের একটি টাইপ নিয়ান্ডারথাল মানব উত্তর ইউরোপে বাস করত।
প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে বিশ্বে প্রায়-মানব ক্রোমানিয়া মানব ইউরোপের পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করে। এরা যেসব পশু শিকার করত সেগুলোর ছবি এঁকে রাখত। অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করত পাথর, হাড় অথবা কাঠ। মানুষ খ্রিস্টপূর্ব আট হাজার বছরের আগে চাষাবাদ করতে শেখেনি । বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আদি মানবের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৯১ সালে ইন্দোনেশিয়ায়র জাভায় আদি মানবের মাথার খুলি আবিষ্কৃত হয় । পূর্ব জাভার সোলো নদীর তীরে এ মাথার খুলি পাওয়া যায়। হাইডেলবার্গ মানবের নিচের চোয়ালের হাড় আবিষ্কার করেন একজন জার্মান গবেষক ১৯০৭ সালে।
জাভা মানব → হেইডেলবার্গ মানব → পিকিং মানব → অস্ট্রালোপিতিসিন্স লুসি
- জাভা মানব : ১৮৯১ সালে ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্গত পূর্ব জাভার সোলো নদীর তীরে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মাথার খুলি আবিষ্কৃত হয়। এই আদি মানবের নাম দেওয়া হয় জাভা মানব।
- হেইডেলবার্গ মানব : ১৯০৭ সালে জার্মানির হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক প্রাগৈতিহাসিক মানুষের নিচের চোয়ালের হাড় আবিষ্কার করেন এবং নামকরণ করেন 'হেইডেলবার্গ মানব'।
- পিকিং মানব : ১৯২৯ সালে পিকিংয়ের [আধুনিক বেইজিং] নিকট পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মাথার খুলি। এ আদি মানুষের নাম দেওয়া হয় পিকিং মানব।
- অস্ট্রালোপিতিসিন্স লুসি : ১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর ইথিওপিয়ায় ৩.২ মিলিয়ন বছরের পুরোনো কংকাল আবিষ্কৃত হয়। কংকালটির নামকরণ করা হয় লুসি [Lucy]। এর স্পেসিস: Australopithecus afarensis .
মেসোপটেমীয় সভ্যতা
মেসোপটেমীয় সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতা ।
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে মিশরে যখন নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তখন প্রায় একই সময়ে আজকের ইরাক অঞ্চলে গড়ে উঠে আরো কিছু উন্নত নগর সভ্যতা।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস [বর্তমানে দোজলা ও ফোরাত] নদীর উর্বর তীরাঞ্চলে সময়ের পরিবর্তনে বেশ কয়েকটি সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও একই ভূখণ্ডে গড়ে উঠায়
একত্রিতভাবে এ সভ্যতাসমূহকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। 'মেসোপটেমিয়া' একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি। মেসোপটেমিয়ার পূর্বে টাইগ্রিস এবং পশ্চিমে ইউফ্রেটিস নদী প্রবাহিত।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সুমেরীয় সভ্যতা,
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা।
[বেশিরভাগ এলাকা ছিল বর্তমান ইরাক; এছাড়া ইরান, তুরস্ক, সিরিয়াও এর মাঝে ছিল]
[ ক ] সুমেরীয় সভ্যতা [The Sumerian Civilization] : মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তুলেছিল সুমেরীয়গণ। সুমেরীয়দের আদিবাস ছিল এলামের পাহাড়ি অঞ্চলে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে এদের একটি শাখা মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণে বসতি গড়ে তোলে।
- সুমেরীয়দের আয়ের মূল উৎস ছিল কৃষি। তারা উন্নত সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
- সুমেরীয়গণ 'কিউনিফর্ম' (Cuneifom) নামে একটি নতুন লিপির উদ্ভাবন করে। কিউনিফর্মকে বলা হয় অক্ষরভিত্তিক বর্ণলিপি Letter Based alphabet]। সুমেরীয়দের বর্ণমালার কোন কোনটি দেখতে ইংরেজি বর্ণমালার V এর মত।
- জলঘড়ি ও চন্দ্রপঞ্জিকার আবিষ্কার সুমেরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
- সভ্যতায় সুমেরীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান 'চাকা' [Wheel] আবিষ্কার।
- পাটিগণিতের গুণ পদ্ধতি আবিষ্কার
- তাদের প্রধান দেবতা ছিল নাগাল। জিগুরাত তাদের ধর্ম মন্দির।
[ খ ] ব্যাবিলনীয় সভ্যতা [The Babylonian Civilization] : সিরিয়ার মরুভূমি অঞ্চলের অ্যামোরাইট জাতি আনুমানিক ২০৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে একটি নগর সভ্যতা গড়ে তোলে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার স্থপতি ছিলেন বিখ্যাত আমোরাইট নেতা হাম্বুরাবি।
- ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান আইনের ক্ষেত্রে। আইন সংকলক হিসাবে হাম্মুরাবি অমর হয়ে আছেন।
- সুমেরীয়দের অনুকরণে তাঁরা সাহিত্য রচনা করে। কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা হয় বিখ্যাত মহাকাব্য 'গিলগামেশ' [Gilgamesh]
- পৃথিবীর প্রাচীনতম মানচিত্র পাওয়া যায় ব্যাবিলনের উত্তরের গাথুর শহরের ধ্বংসাবশেষে। এটি ছিল ভ্রমণকারীদের পথ নির্দেশ করার জন্য সহজ ও সরল প্রকারের মানচিত্র।
[ গ ] অ্যাসেরীয় সভ্যতা [ The Assyrian Civilization] : ব্যাবিলন থেকে প্রায় দুইশত মাইল উত্তরে টাইগ্রিস নদীর তীরে 'আশুর' নামে একটি সমৃদ্ধ শহর গড়ে উঠে। আসিরীয় সম্রাট নিজেকে মনে করতেন সূর্যদেবতা 'শামসের' প্রতিনিধি। ইতিহাসে আসিরিয়ার পরিচয় সামরিক রাষ্ট্র হিসাবে। তারাই প্রথমে 'লোহার অস্ত্রে' সজ্জিত বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধরথের ব্যবহার করে।
- আসিরীয়রা প্রথম বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রি তে ভাগ করে।
- পৃথিবীকে সর্বপ্রথম তারা অক্ষাংশ [Latitudes] ও দ্রাঘিমাংশে [Longitudes) ভাগ করেছিল।
- ৬১২ খ্রিস্টপূর্ব-তে এই সভ্যতার পতন হয়।
[ ঘ ] ক্যালডীয় সভ্যতা [The Chaldean Civilization] : ব্যাবিলন শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠায় ক্যালডীয় সভ্যতা ইতিহাসে 'নতুন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা' নামেও পরিচিত। ক্যালডীয় সভ্যতার স্থপতি ছিলেন সম্রাট নেবুচাদনেজার।
- সম্রাট নেবুচাদনেজারের সম্রাজ্ঞী খুব পছন্দ করতেন বাগান করতে। তাঁরই উৎসাহে সম্রাট নগর দেওয়ালের উপর তৈরি করলেন আশ্চর্য সুন্দর এক বাগান। ইতিহাসে যা 'ঝুলন্ত উদ্যান' নামে পরিচিত। 'ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান' [The Hanging Garden of Babylon] প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি।
- ক্যালডেরীয়রাই প্রথম সপ্তাহকে ৭ দিনে বিভক্ত করে। আবার প্রতিদিনকে ১২ জোড়া ঘন্টায় ভাগ করার পদ্ধতি বের করে। বছরের দৈর্ঘ্যও তারা বের করতে পেরেছিল।
- ক্যালডেরীয়রা ১২ টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পান। তা থেকে ১২ টি রাশিচক্রের [12 Zodiac Circles] সৃষ্টি হয়।
- পারস্যের আক্রমণে এই সভ্যতার পতন হয়।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা
মিশরে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরের এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস মিশরকে বলেছেন 'নীল নদের দান' [Gift of the Nile]। এ সময় মিশর [নগর সভ্যতার সূচনা এখানে ] কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে বলা হত 'নোম'। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে 'মেনেস' নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। দক্ষিণ মিশরের 'মেম্ফিস' হয় এর রাজধানী। এভাবে মিশরে রাজবংশের সূচনা হয়।
- ধর্মঃ ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ বহুদেবতার পরিবর্তে একমাত্র সূর্যদেবতার আরাধনার কথা প্রচার করেন। সূর্যদেবতার নাম দেওয়া হয় 'এটন'। দেবতার নামের সাথে মিল রেখে তিনি নিজের নাম রাখেন 'ইখনাটন'। এভাবে ইখনাটন সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঈশ্বরের ধারণা দেন।
- স্থাপত্য ও ভাস্কর্যঃ প্রাচীন মিশরের রাজাদের বলা হত 'ফারাও' [Pharaoh]। মিশরীয়রা মৃত্যুর পর আরেকটি জীবনের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। সে জীবনেও রাজা হবেন ফারাও। তাই ফারাওর মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয় পিরামিড। মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিড হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড। খুফুর পিরামিড গড়ে উঠেছিল তের একর জায়গা জুড়ে। এর উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে চারশত ফুট। মিশরীয় ভাস্করদের সবচেয়ে বড় গৌরব 'স্ফিংস' তৈরিতে। বহুখণ্ড পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হত এ ভাস্কর্য। স্ফিংসের দেহ সিংহের আকৃতির, আর মাথা ছিল ফারাওয়ের। ফারাওদের আভিজাত্য শক্তির প্রতীক ছিল এ মূর্তি।
- লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবনঃ মিশরীয়রা একটি লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। প্রথম দিকে ছবি এঁকে এঁকে মিশরীয়রা মনের ভাব প্রকাশ করত। এক একটি ছবি ছিল এক একটি অক্ষরের প্রতীক। তাই এ লেখার নাম দেওয়া হয় চিত্রলিপি [Pictograph]। অক্ষরভিত্তিক মিশরীয় এ চিত্রলিপিকে বলা হয় 'হায়ারোগ্লিফিক' [Hierogryphic]। গ্রিক শব্দ 'হায়ারোগ্লিফিক’ অর্থ পবিত্রলিপি। 'প্যাপিরাস' নামক এক ধরনের নল গাছের বাকল দিয়ে তারা সাদা রঙের কাগজও তৈরি করত।
- বিজ্ঞানঃ মিশরীয়রা সর্বপ্রথম ১২ মাসে ১ বছর, ৩০ দিনে ১ মাস এই গণনারীতি চালু করেন। যেহেতু ফারাও মৃত্যুর পর পরকালে রাজা হবেন সেহেতু তাঁর মৃতদেহকে পচন থেকে রক্ষার জন্য মিশরীয় বিজ্ঞানীরা মমি তৈরি করতে শেখেন। ৩৬৫ দিনে বছর গণনা শুরু করে।
সিন্ধু সভ্যতা
মিশর ও মেসোপটেমিয়ায় যখন গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা, প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারতবর্ষেও গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা। এটি ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা। এখানে লোহার কোন জিনিস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কৃত হয় ১৯২১ সালে। সভ্যতাটি সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বলে এটি 'সিন্ধু সভ্যতা' নামে পরিচিত। দ্রাবিড় জাতি এ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল বলে মনে করা হয়। হরপ্পা নগরীটি গড়ে উঠেছিল সিন্ধুর উপনদী রাভী'র তীরে। এটি অবস্থিত বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। আর মূল সিন্ধুনদের তীরে এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো নগরী। ১৯২২ সালে পাকিস্তানের লারকানা জেলায় মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করা হয় মহেঞ্জোদারো নগরীর ধবংসাবশেষ। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক জন মার্শাল, দয়ারাম সাহনী ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া সীল ও মাটির পাত্রের সাথে মেসোপটেমিয়া/ সুমেরীয় সভ্যতার দ্রব্যের মিল আছে। 'নৃত্যরত নারী' এই সভ্যতার শিল্প নিদর্শন।
- নগর পরিকল্পনাঃ সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা পরিকল্পিত একটি নগরীর ধারণা দিয়েছে। উভয় শহরে রাস্তার দুপাশে দোতলা তিনতলা বাড়ি ছিল। প্রতি বাড়িতে ছিল চৌবাচ্চাসহ গোছলখানা, কূপ। দুইটি শহরেই পাকা নর্দমা ছিল।
- পেশাঃ সিন্ধু সভ্যতার বেশিরভাগ লোক কৃষিকাজ করত।
- পরিমাপ পদ্ধতিঃ সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল পরিমাপ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। দ্রব্য ওজনের জন্য নগরবাসী বিভিন্ন পরিমাপের বাটখারা ব্যবহার করত। দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য তারা বিভিন্ন স্কেল ব্যবহার করত।
- সীলমোহরঃ মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় হাড় ও পাথরের তৈরি সীলমোহর পাওয়া গেছে।
- সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণঃ সিন্ধু সভ্যতার পতন শুরু হয় আনুমানিক ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে । কিভাবে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হয় সে বিষয়ে পণ্ডিতগণ সঠিক কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। হয়তো বাহিরের কোন শত্রুর আক্রমণ অথবা প্রচন্ড কোন ভূমিকম্প বা ভয়াবহ কোন বন্যার ফলে এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়।
ফিনিশীয় সভ্যতা
লেবানন পর্বত এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝামাঝি এক ফালি সরু ভূমিতে ফিনিশীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। কৃষিকাজ করার মত এখানে উর্বর জমি ছিল না। তাদের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল বাণিজ্য।
- ফিনিশীয়দের অবদান : প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে ফিনিশীয়দের পরিচয় শ্রেষ্ঠতম নাবিক ও জাহাজ নির্মাতা হিসাবে। ধ্রুবতারা [North Star] দেখে তারা দিক নির্ণয় করত। এ কারণে ধ্রুবতারা অনেকের কাছে 'ফিনিশীয় তারা' [Phonecian Star] নামে পরিচিত ছিল।
- সাংস্কৃতিক উন্নতি : সভ্যতার ইতিহাসে ফিনিশীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান হল বর্ণমালা [Alphabet] এর উদ্ভাবন। তারা ২২ টি ব্যঞ্জনবর্ণেও [Consonants] উদ্ভাবন করে। আধুনিক বর্ণমালার সূচনা হয় এখান থেকে। ফিনিশীয়দের উদ্ভাবিত বর্ণমালার সাথে পরবর্তীতে গ্রিকরা স্বরবর্ণ [Vowels] যোগ করে বর্ণমালাকে সম্পূর্ণ করে।
- কারিগরি দক্ষতা : ফিনিশীয়রা মাটির পাত্র তৈরি করতে পারত। দক্ষতার সাথে কাপড় তৈরি ও রং করতে পারত। ইউরোপীয়রা এদের কাছে কাগজ, কলম, বালির ব্যবহার শেখে।
পারস্য সভ্যতা
আজকের ইরান প্রাচীনকালে পারস্য নামে পরিচিত ছিল। [একে প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যও বলা হয় ] খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ৬০০ অব্দের মধ্য এখানে আর্যরা এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলে। এ সভ্যতার অধিবাসীরা সামরিক শক্তিতে খ্যাতিমান ছিল। সভ্যতার ইতিহাসে দুইটি ক্ষেত্রে পারসীয়দের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি সুষ্ঠ ও দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ক্ষেত্রে নতুন ধারণা নিয়ে আসা। জরথুষ্ট্র নামে পারস্যে এক ধর্মগুরু ও দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। জরথুষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম 'জরথুষ্ট্রবাদ' নামে পরিচিত। পারস্যের ইতিহাসে কাইরাস ও দারিয়ুস ছিলেন সবচেয়ে সফল শাসক। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার অধিকার করে নেন সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যকে।
হিব্রু সভ্যতা
প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম নগরীকে কেন্দ্র করে হিব্রু সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। হিব্রু কোন জাতির নাম নয়। 'হিব্রু' একটি সেমাটিক ভাষা। এ ভাষায় কথা বলা লোকেরাই হিব্রু নামে পরিচিত। হিব্রুদের আদিবাস ছিল আরব মরুভূমিতে। বর্তমান ইসরাইলের অধিবাসীরা হিব্রুদের বংশধর। হিব্রুরা তাদের অবদানের পুরোটাই রেখেছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। হিব্রুরা সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে। অবশ্য অনেককাল পূর্বে মিশরের ফারাও ইখনাটন এক দেবতার আরাধনার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা তেমন জনপ্রিয় হতে পারেনি। হিব্রুদের নবী হযরত মুসা [আ.], হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত সুলায়মান [আ.] মানুষের প্রচলিত ধর্মীয় চেতনায় নতুন আলোড়ন তোলেন।
প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা
তিনটি অঞ্চলে প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা বেড়ে উঠতে থাকে। প্রথমটি হোয়াংহো [Yellow river/ পীত নদী ] নদীর তীরে, দ্বিতীয়টি ইয়াংসিকিয়াং নদীর তীরে আর তৃতীয়টি দক্ষিণ চীনে গড়ে উঠেছিল।
দর্শনঃ চীনের প্রাচীনতম দার্শনিক ছিলেন লাওৎসে। তাঁর মতবাদের নাম ছিল তাওবাদ। চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন কনফুসিয়াস [৫৫১-৪৭৯ খ্রি.পূ.]। কনফুসিয়াসের প্রধান অনুসারী ছিলেন মেনসিয়াস। কনফুসিয়াসের দর্শন ধর্মে পরিণত হয় ২০৬ B.C.তে। চীনা জনগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত।
ইজিয়ান সভ্যতা
গ্রিস ও এশিয়া মাইনরকে পৃথক করেছে ইজিয়ান সাগর। এই ইজিয়ান সাগর জুড়ে ছিল ছোট বড় অনেক দ্বীপ। ইজিয়ান সাগরের দ্বীপমালা ও এশিয়া মাইনরের উপকূলে একটি উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠে। ইতিহাসে এ সভ্যতা ইজিয়ান সভ্যতা নামে পরিচিত। গ্রিসে সভ্যতা গড়ে তোলার প্রস্তুতিপর্ব ছিল এ সভ্যতা। ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইজিয়ান সভ্যতার পতন ঘটে। গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি থেকে এই সভ্যতার তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রিক সভ্যতা
গ্রিসের ভৌগোলিক পরিবেশ ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। এ অঞ্চলে অনেকগুলো পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালের মত। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় দেশটি। এ ছোট দেশগুলোর নাম হয় নগর রাষ্ট্র। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল স্পার্টা ও এথেন্স। স্পার্টা ছিল একটি সামরিক নগর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রনেতারা ছিল স্বৈরাচারী। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার থাকলে সে ব্যবস্থাকে বলে গণতন্ত্র। প্রাচীন পৃথিবীতে এথেন্সই সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের সূচনা করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তখন দুইটি সংসদ ছিল। গোত্র প্রধানদের নিয়ে গড়া সংসদকে বলা হত 'এরিওপেগাস' এবং সাধারণ নাগরিকদের সমিতিকে বলা হত 'একলেসিয়া'। এথেন্সে চূড়ান্তভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন পেরিক্লিস। পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় আসেন ৪৬০ B.C.তে।
পেলোপনেসীয় যুদ্ধঃ স্পার্টা ও এথেন্স উভয় দেশ একে অন্যের শত্রু ছিল। এথেন্স তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে। এর নাম হয় 'ডেলিয়ান লীগ'। অন্যদিকে স্পার্টা তাঁর বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে গঠন করে আরেকটি জোট। এ জোটের নাম হয় 'পেলোপনেসীয় লীগ'। এক সময় এই দুই জোটের মধ্য যুদ্ধ বেধে যায়। ইতিহাসে এ যুদ্ধ 'পেলোপনেসীয় যুদ্ধ' নামে পরিচিত। ৪৬০ থেকে ৪০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মোট তিনবার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত পতন ঘটে এথেন্সের।
ভৌগোলিক অবস্থান: ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে গ্রিক সভ্যতার সাথে দুইটি সংস্কৃতির নাম জড়িয়ে আছে। একটি 'হেলেনিক' [Hellenic] এবং অন্যটি 'হেলেনিস্টিক' [Hellenistic]| গ্রিসের প্রধান শহর এথেন্সে শুরু থেকেই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় হেলেনিক সংস্কৃতি। গ্রিস উপদ্বীপ ছিল এ সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দ পর্যন্ত হেলেনিক সভ্যতা টিকে ছিল। এ সময় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিক সংস্কৃতি ও অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়। ইতিহাসে এ সংস্কৃতির পরিচয় হয় হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি নামে।
সভ্যতায় গ্রিসের অবদান
দর্শনঃ গ্রিকদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দর্শন চর্চায়। প্রথম দিকের বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন থ্যালেস। থ্যালেস কল্পকাহিনীর বদলে প্রথম সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। ধীরে ধীরে গ্রিসে এক ধরনের যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। এঁদের বলা হত সফিস্ট। সক্রেটিস ছিলেন এ দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান। আদর্শ রাষ্ট্র ও সৎ নাগরিক গড়ে তোলা ছিল তাঁর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করার শিক্ষা দেন তিনি। এতে শাসক শ্রেণী ভীত হয়ে পড়ে। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শাসক গোষ্ঠী এ মহান দার্শনিককে হেমলক লতার তৈরি বিষ খাইয়ে হত্যা করে।
শিক্ষক | ছাত্র |
---|---|
সক্রেটিস | প্লেটো |
প্লেটো | এরিস্টটল |
এরিস্টটল | সম্রাট আলেকজান্ডার |
সক্রেটিসের ছাত্র দার্শনিক প্লেটো গ্রিক দর্শনকে চরম উন্নতির দিকে নিয়ে যান। তিনি তাঁর চিন্তাগুলো ধরে রাখেন 'রিপাবলিক' নামক গ্রন্থ রচনা করে। তিনি সক্রেটিসের শিক্ষার বক্তব্যগুলো নিয়ে 'ডায়ালগস অব সক্রেটিস' নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্লেটো ৩৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দর্শনের স্কুল 'akademia' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল একজন বড় দার্শনিক ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'পলিটিক্স'। 'লাইসিয়াম' হল এরিস্টটল এর প্রতিষ্ঠান।
- ধর্ম: গ্রিকরা বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিল। গ্রিকদের প্রধান দেবতা ছিলেন জিউস। দেবতা এপোলো ও দেবী এথেনাও ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিকবাসী বিশ্বাস করত দেবতাদের বাস উত্তর গ্রিসে অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায়।
- সাহিত্য: গ্রিক মহাকবি হোমার হাজার হাজার বছরের পুরোনো কাহিনী নিয়ে রচনা করেন মহাকাব্য 'ইলিয়ড' আর 'ওডিসি' । গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার ছিলেন 'এস্কাইলাস'। তাঁর বিখ্যাত দুইটি নাটকের নাম 'প্রমেথিউস বাউন্ড' ও 'আগামেমনন'। নাট্যকার সফোক্লিস একশটিরও বেশি নাটক লেখেন। এর মধ্যে জনপ্রিয় দুইটি হচ্ছে 'এন্টিগনে' ও 'ইলেক্ট্রা'। সফোক্লিসের বিখ্যাত ট্রাজেডি 'রাজা ঈদিপাস'। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও সমান কৃতিত্ব ছিল গ্রিকদের। গ্রিক ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। অন্য খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ছিলেন 'থুকুডাইডিস'। তাঁকে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনক বলা হয়।
- অলিম্পিক খেলা : অলিম্পিক খেলা শুরু হয় ৭৭৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এ খেলায় বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা অংশ নিত। এ খেলার সূত্র ধরে পারস্পরিক শত্রুতার বদলে গ্রিকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে উঠে।
- বিজ্ঞান : গ্রিক বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। তারাই প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী একটি গ্রহ এবং তা নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয়। বিখ্যাত গ্রিক গণিতবিদ 'পিথাগোরাস' খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জন্ম নিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে জন্ম নেন বিজ্ঞানী 'এনাক্সাগোরাস'। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গণিতের জ্যামিতি (উপপাদ্য) তার অবদান।
- স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: কয়েকজন খ্যাতিমান গ্রিক ভাস্কর হচ্ছেন মাইনর, ফিদিয়াস এবং প্রাকসিটেলেস।
গ্রিক দেবী বা দেবতার নাম | পরিচিতি |
---|---|
আফ্রোডায়িট [Aphrodite) | ভালবাসা, রোমাঞ্চ এবং সৌন্দর্যের দেবী |
অ্যাপোলো [Apollo] | সূর্য, আলো, চিকিৎসাবিদ্যা এবং সঙ্গীতের দেবতা |
এরিস [Ares] | যুদ্ধদেবতা |
আরটেমিস [Artemis] | শিকার, বন, উর্বরতা এবং চাঁদের দেবী |
এথেনা [Athena] | প্রজ্ঞার দেবী। [ জিউসের কন্যা ] |
ডিমিটার [Demeter] | কৃষি বিষয়ক দেবী |
হারমেস [Hermes] | ব্যবসা বিষয়ক দেবতা [রোমান নাম মারকারি] |
হেরা [Hera ] | বিবাহ বন্ধন অটুট রাখার দেবী। [জিউসের স্ত্রী] |
জিউস [Zeus] | দেবতাদের রাজা [ প্রধান দেবতা ] |
রোমান সভ্যতা
ইতালির পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছোট্ট শহর রোমকে কেন্দ্র করে রোমান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর একদল মানুষ ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে উত্তর ইতালিতে বসতি গড়ে তোলে। এদের বলা হত ল্যাটিন। ক্রমে এদের ভাষা 'ল্যাটিন ভাষা' নামে পরিচিতি পায়। ল্যাটিন রাজা রোমিউলাস একটি নগরীর পত্তন করেন। রাজার নামেই নগরীর নাম হয় রোম। দাসশ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল রোমের অর্থনীতি। দাসদের উপর অমানবিক অত্যাচার করা হত। অবশেষে স্পার্টাকাস নামক একজন দাসের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় দাস বিদ্রোহ। বিদ্রোহী দাসরা দুইবছর দক্ষিণ ইতালিতে টিকে ছিল। স্পার্টাকাস ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিহত হলে দাস বিদ্রোহের অবসান হয়।
রোমের সবচেয়ে খ্যাতিমান সম্রাট ছিলেন জুলিয়াস সিজার। তিনি ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমের সম্রাট হন। কিন্তু রোমে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র প্রবল হতে থাকলে ব্রটাস ও ক্যাসিয়াস নামের দুই অভিজাতের হাতে জুলিয়াস সিজার নিহত হন। এবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রোম। অবশেষে তিন নেতা একযোগে ক্ষমতায় আসেন। এরা হলেন অক্টেভিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি এবং লেপিডাস। এ তিনজনের একত্র শাসনকে ইতিহাসে 'ত্রয়ী শাসন' বলা হয়। ত্রয়ী শাসন বেশিদিন টেকেনি। অক্টেভিয়াস সিজার প্রথমে পরাজিত করেন লেপিডাসকে। এন্টনি মিশরের রাজকন্যা ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন অক্টেভিয়াস সিজারের হাতে। এভাবে রোমান সম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে অক্টেভিয়াস সিজার অগাস্টাস সিজার উপাধি গ্রহণ করেন। অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্টের জন্ম। অগাস্টাস সিজার ১৪ সালে মারা যান। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাজ্যের পতন হয়। শেষ রোমান সম্রাট ছিলেন রোমিউলাস অগাস্টুলাস।
- রোমান রাজা কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট খ্রিষ্টান ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়।
- রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে ০৬ B.C.তে।
- দর্শন: রোমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দার্শনিক মতবাদের নাম 'স্টোয়িকবাদ'। এ দর্শনের উন্নয়নের পিছনে তিন ব্যক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল। এরা ছিলেন ধনী রোমান 'সেনেকা', অন্যজন এক দাস 'এপিকটেটাস' এবং শেষ ব্যক্তিত্ব হলেন রোমান সম্রাট 'মার্কাস অরেলিয়াস'। তাঁরা মনে করতেন, সুখ লাভ করার জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সত্যবাদী হওয়া।
- সাহিত্য: এ যুগের কবি হোরাস ও ভার্জিল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভার্জিলের মহাকাব্য 'ঈনিড' বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওভিদ [তার বিখ্যাত পত্রকাব্য 'Heroides'] ও লিভি এ যুগের অন্য দুই খ্যাতিমান কবি। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস এ যুগে রোমে জন্ম নিয়েছিলেন।
- স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: রোমের একটি বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে সম্রাট হাড্রিয়ানের তৈরি ধর্মমন্দির 'প্যানথিয়ন'। কলোসিয়াম নামে রোমে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নাট্যশালা তৈরি হয়েছিল। এখানে একসাথে ৫৬০০ দর্শক বসতে পারত।
- আইন: রোমানদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব আইনের ক্ষেত্রে। বার্জেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ রোমান আইন সংকলিত করেন। আইনের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে রোমান আইনের উপর নির্ভরশীল। সংকলন করা হয় ১২টি ব্রেঞ্জের পাত্রে।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অপর নাম হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য। ইসলামী বিশ্বে এই সাম্রাজ্য 'রুম' নামে পরিচিত ছিল। রোমান সম্রাট প্রথম কন্সট্যান্টাইন [রাজত্বকাল: ৩০৬-৩৩৭ খ্রি.] ছিলেন প্রথম বাইজেন্টাইন সম্রাট। তিনিই ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোম থেকে তার রাজধানী বাইজেন্টিয়ামে সরিয়ে আনেন এবং এ শহরকে কনস্টান্টিনোপল নামে পুনর্গঠিত করেন।
ইনকা সভ্যতা
ইনকা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল- দক্ষিণ আমেরিকায়। পেরুর দক্ষিণাংশে শক্তিশালী ইনকা সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইনকা সভ্যতার ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৪৩৮-১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইনকা সভ্যতার শক্তিশালী সম্রাটগণ তাদের বাসস্থান হিসাবে মাচুপিচু নগরী গড়ে তুলেছিলেন। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল আন্দিয়ান পর্বতমালা। Manco Capac কে ইনকা সাম্রাজ্যের/ সভ্যতার স্থপতি বলে। ইনকা সভ্যতা বর্তমান পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলির একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
হিট্রাইট সভ্যতা
এই সভ্যতার লোকেরা ১ম লোহার ব্যবহার শুরু করে। এরা বাস করত এশিয়া মাইনরে। এ অঞ্চলেই ১২০০ B.C. তে লৌহযুগের সূচনা হয়। হিট্রাইট সাম্রাজ্য পরিচালনা করে ১৬০০ - ১২০০ B.C. পর্যন্ত। ১৯০৬ সালে এশিয়া মাইনরের খননকালে হিট্রাইটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। [এশিয়া মাইনরের অপর নাম Anatolia]
মায়া সভ্যতা
মায়া সভ্যতা বিরাজমান ছিল বর্তমান যুগের মধ্য আমেরিকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেক্সিকোর জুকাটান উপদ্বীপ থেকে মায়া সভ্যতার যাত্রা শুরু, যা বর্তমানের গুয়েতেমালা, বেলিজ, এলসালভাদর এবং হন্ডুরাস জুড়ে প্রসারিত হয়েছিল।
প্রাচীন সভ্যতা মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাচীন সভ্যতাগুলি আমাদের পূর্বপুরুষদের অসাধারণ জ্ঞান, দক্ষতা, এবং সৃজনশীলতার প্রমাণ। প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে জানা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের বিশ্ব সম্পর্কে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে।