বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ। ল্যান্ডলাইন সংযোগ ছিল দুর্লভ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই ব্যবস্থা দ্রুত বিকশিত হয়েছে এবং বর্তমানে এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ টি মোবাইল অপারেটর এবং ১ টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অপারেটর রয়েছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৯ কোটি ছাড়িয়েছে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি। 4G এবং 5G প্রযুক্তি চালু হয়েছে এবং দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত বর্ধনশীল।

টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জিডিপিতে ৬.৫% অবদান রাখে এবং ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। এটি দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন এবং স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) হলো বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ সেবা নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য গঠিত একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিটিআরসি ১৬ এপ্রিল, ২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটি ৩১ জানুয়ারি, ২০০২ সালে কার্যক্রম শুরু করে। এর সদর দপ্তর ঢাকা । চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ তে এর আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে । যে কেউ বিটিআরসির ১০০ নাম্বারে কল করে সর্বদা টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত অভিযোগ করতে পারেন । বিটিআরসি-এর বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । BTRC এর পূর্ণরূপ Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission .

বিটিআরসির কার্যক্রম:

  • লাইসেন্স প্রদান : টেলিকম অপারেটরদের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন
  • ট্যারিফ নিয়ন্ত্রণ : টেলিযোগাযোগ সেবার মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ
  • সুবিধা নিশ্চিত : গ্রাহকদের মানসম্পন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা
  • বাজার পর্যবেক্ষণ : টেলিযোগাযোগ বাজার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা
  • বিরোধ নিষ্পত্তি : টেলিকম অপারেটর ও গ্রাহকদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি
  • গবেষণা ও উন্নয়ন : টেলিযোগাযোগ সেবার উন্নয়নে গবেষণা ও উন্নয়ন

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) বাংলাদেশের সরকারি মালিকানাধীন একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি। এটি দেশের বৃহত্তম টেলিকমিউনিকেশন অপারেটর এবং ল্যান্ডলাইন, মোবাইল, ইন্টারনেট এবং ডেটা সহ বিভিন্ন ধরণের টেলিকমিউনিকেশন পরিষেবা প্রদান করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) নাম নিয়ে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । তবে বর্তমানে এর নাম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। ১ জুলাই, ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয় এবং বিটিসিএল হিসেবে নামকরণ করা হয় । বিটিসিএল যাত্রা শুরু করে ১ জুলাই, ২০০৮ সালে । BTCL এর সদর দপ্তর ঢাকার ইস্কাটনে । তবে দেশের ৬৪ জেলায় এর আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে । BTCL এর পূর্ণরূপ Bangladesh Telecommunication Company Limited .

বিটিসিএলের কার্যক্রম:

  • ল্যান্ডলাইন: টেলিফোন সংযোগ প্রদান
  • মোবাইল: 'বিটিসিএল মোবাইল' নামে মোবাইল সেবা প্রদান
  • ইন্টারনেট: 'বিটিসিএল ইন্টারনেট' নামে ইন্টারনেট সেবা প্রদান
  • ডেটা: বিভিন্ন ধরণের ডেটা সার্ভিস প্রদান
  • অন্যান্য: বিডিএসএম, আইপিএলসি, ওয়েব হোস্টিং, ভিপিএন ইত্যাদি

ভয়েজ ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (VOIP) : VOIP = Voice Over Internet Protocol। এ প্রটোকলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে টেলিফোনে কথা বলা যায়।

টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত বাংলাদেশে প্রথম

  • বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ফোন চালু হয় : ৪ জানুয়ারি, ১৯৯০
  • বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা হয় :রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়।
  • বাংলাদেশের প্রথম কার্ড ফোন চালু হয় : ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২
  • বাংলাদেশে প্রথম সেলুলার ফোন ব্যবস্থা চালু হয় : ৮ আগস্ট, ১৯৯৩
  • বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয় : ৪ জুন, ১৯৯৬ সালে
  • বাংলাদেশে তারহীন ইন্টারনেট প্রযুক্তি চালু হয় : ২১ জুলাই, ২০০৯
  • বাংলাদেশে প্রথম V-Sat স্থাপন করা হয় : ২০০১ সালে বুয়েটে
  • মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর অনুপাত : প্রতি পাঁচজনে তিনজন
  • ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের কোন টেলিযোগাযোগ নেই।
  • বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৬ লাখ ।

বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানি

বাংলাদেশে ৪টি মোবাইল ফোন কোম্পানি (গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও টেলিটক) বর্তমানে চালু আছে। নিচে কোম্পানিগুলোর বিবরণ দেয়া হল:

বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানি
নাম যাত্রাশুরু Key Notes
প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ (সিটিসেল) ১৯৯৩ বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন কোম্পানি। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর বিটিআরসি সিটিসেল এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেন । বর্তমানে এটি বন্ধ আছে।
গ্রামীণফোন লিমিটেড (জিপি) ১৯৯৭ গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন কোম্পানি।
রবি এক্সিয়াটা লিমিটেড (রবি) ১৯৯৭ রবি ও এয়ারটেল একীভূত হয় ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬। প্রথম জিপিআরএস ব্যবস্থা চালু করে।
বাংলা লিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড (বাংলা লিংক) ২০০৫ গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম মোবাইল ফোন কোম্পানি।
টেলিটক বাংলাদেশ লিঃ ২০০৫ বাংলাদেশের একমাত্র সরকারী মোবাইল ফোন কোম্পানি।
এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৭ বাংলাদেশের সর্বশেষ মোবাইল ফোন কোম্পানি। বর্তমানে রবির সাথে একীভূত।
  • দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় যশোর। ২০ ডিসেম্বর ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরকে দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা হিসেবে ঘোষণা করেন। আর বাংলাদেশে প্রথম সাইবার সিটি নির্মিত হয়েছে সিলেটে।
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দেশের মোবাইল কোম্পানীগুলো 4G সেবা চালু করে। (বিশ্বে প্রথম ২০০৬ সালে, দ. কোরিয়া)
  • ২৩ জুন ২০১৪ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় www.bangladesh.gov.bd নামের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল। এ ওয়েবপোর্টালের মাধ্যমে ঘরে বসেই সাধারণ মানুষ সরকারের নানাবিধ সেবা গ্রহণ করতে পারে।

MNP যুগে বাংলাদেশ

মোবাইল ফোনের নম্বর অপরিবর্তিত রেখে অন্য অপারেটরের সেবা নেয়ার সুবিধাকে বলা হয় Mobile Number Portabilit (MNP) সেবা। এ ব্যবস্থায় একজন গ্রাহক নম্বর অপরিবর্তিত রেখেই নিজেদের ইচ্ছেমতো এক অপারেটর থেকে আরেক অপারেটরে যেতে পারেন। ১ এপ্রিল ১৯৯৭ সিঙ্গাপুরে প্রথম চালু হয় MNP সেবা। আর ১ অক্টোবর ২০১৮ বিশ্বের - ৭২তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে MNP সেবা চালু হয়। ২১ অক্টোবর ২০১৮ আনুষ্ঠানিকভাবে এ সেবা উদ্বোধন করা হয়।

তথ্য ও সেবা

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (a2i) জনগণের দোরগোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে আরো কটি জাতীয় হেল্পডেস্ক চালু করে । এক বছর পরীক্ষামূলক দেখার পর ১২ এপ্রিল ২০১৮ আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৩৩ নম্বরের তথ্যসেবার জাতীয় এ হেল্পডেস্ক উদ্বোধন করা হয়। এ কলসেন্টারে ফোন করে তথ্য সেবার পাশাপাশি নানা নাগরিক সমস্যার প্রতিকারও মিলবে। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে এ সেবা দেয়া হবে ০৯৬৬৬৭৮৯৩৩৩ নম্বরে। দেশে প্রথম জাতীয় হেল্পডেস্ক ৯৯৯ চালু হয় ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি পুলিশি সেবা দেয়ার জন্য। তবে ৯৯৯-এর মতো ৩৩৩ কল ফ্রি নয়। রেগুলার ভয়েস কলের চার্জ হবে এখানে। প্রতি মিনিটে ৬০ পয়সা কাটা হবে। আর ফিরতি কলে গ্রাহককে সমাধান হলো কি-না জানানো হবে।

ই-পাসপোর্ট

ই-পাসপোর্ট হলো একটি বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট যাতে একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপ থাকে। ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপের মধ্যে রয়েছে বায়োমেট্রিক তথ্য যা পাসপোর্টধারীর পরিচয় প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ ২২ জানুয়ারি, ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও বিশ্বে ১১৯তম দেশ হিসেবে ই-পাসপোর্ট চালু করে। এতে ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা ফিচার সংযুক্ত করা হয়েছে। ই-পাসপোর্টের মেয়াদ হবে বয়স ভেদে ৫ ও ১০ বছর।

أحدث أقدم