ভারত বিভাগপূর্ব রাজনীতি
১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯৩৭ সালে কার্যকর হয়। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৭ সালে প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৪০ টি আসনে, কৃষক প্রজা পার্টি ৩৫ টি আসনে এবং স্বতন্ত্র্য মুসলমান ৪১ টি আসনে এবং স্বতন্ত্র্য হিন্দু ১৪ টি আসনে বিজয়ী হয়। কৃষক প্রজা পার্টি ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
একে ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভা : কোন দল একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন এ.কে ফজলুল হক।
হক মন্ত্রিসভার কৃতিত্বঃ
- ক) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য ১৯৩৮ সালে হক মন্ত্রিসভা একটি কমিশন গঠন করে যা 'ফ্লাউড কমিশন' নামে পরিচিত।
- খ) ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করে জমিদারদের অধিকার হ্রাস এবং কৃষকদের অধিকার বৃদ্ধির চেষ্টা করেন।
- গ) ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় চাষী খাতক আইন প্রবর্তন করেন। এই আইনের ফলে বাংলার সর্বত্র 'ঋণ সালিসি বোর্ড গঠিত হয়।
- ঘ) হক মন্ত্রিসভা বঙ্গীয় কুসিদজীবী আইন (Bengal Money Lenders Act) প্রবর্তন করেন।
- ঙ) ফজলুল হক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন করেন। ঢাকার কৃষি কলেজ এবং বরিশালের চাখার কলেজ স্থাপনের কৃতিত্ব হক সাহেবের। মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্য ঢাকায় ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন
একে ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভাঃ ১৯৪১ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে মতানৈক্যর ফলে এ কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ড. শ্যামপ্রসাদের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভা শ্যামা- হক মন্ত্রিভা নামে পরিচিত। এই মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এ কে ফজলুল হক। ১৯৪৩ সালে এই মন্ত্রিসভার পতন হয়।
লাহোর প্রস্তাব : ১৯৩৯ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, হিন্দু মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। তার এ ঘোষণা 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' হিসাবে পরিচিত। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা ছিল উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। অন্য কোন ব্যবস্থা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের কোন উল্লেখ ছিলনা। তবুও এ প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে এ প্রস্তাবের সংশোধন করা হয়। একাধিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি মাত্র রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
ক্রিপস মিশন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করলে জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে এ দেশীয় সাহায্য সহযোগিতা লাভ করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ১৯৪২ সালে এ উপমহাদেশে প্রেরণ করেন। তিনি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে যে কয়টি প্রস্তাব করেন, তা 'ক্রিপস প্রস্তাব' নামে খ্যাত।
ভারত ছাড় আন্দোলন : ভারতের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে 'ভারত ছাড়' দাবিতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
পঞ্চাশের মন্বন্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা বার্মা দখল করলে এখান থেকে বাংলায় চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বাংলার খাদ্য শস্য ক্রয় করে বাংলার বাহিরে সৈন্যদের রসদ হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অসাধু, লোভী ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা খাদ্য গুদামজাত করে। এছাড়া অনাবৃষ্টির ফলে বাংলার খাদ্য উৎপাদনও হ্রাস পায়। ফলে ১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারিতে প্রায় ৩৫-৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। বাংলা ১৩৫০ সালে সংঘটিত এই দুর্ভিক্ষ 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে পরিচিত।
মন্ত্রী মিশন : ১৯৪৬ সালে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি তার মন্ত্রিসভার তিন সদস্যকে ভারতে প্রেরণ করেন। এ তিন মন্ত্রীবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল মন্ত্রিমিশন নামে পরিচিত।
১৯৪৬ সালের নির্বাচন ও সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা : ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আবুল হাসেম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এটি ছিল অবিভক্ত বাংলার শেষ মন্ত্রিসভা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী
ভারত বিভাগ ও স্বাধীনতা : ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক (হিন্দু মুসলিম) দাঙ্গা হয়। যার ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন সর্বশেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগ নীতি ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলীর অধীনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাশ হয়। ১৪ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের হাতে এবং ১৫ আগস্ট দিল্লিতে ভারতীয়দের হাতে অনুষ্ঠানে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। এমনি করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন। আর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।