ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বিশেষ করে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ও কৃষক বিদ্রোহ। ১৭৬০ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ও মাত্রায় এসব আন্দোলন চলতে থাকে। ঔপনিবেশিক ভূমি ব্যবস্থা, ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ, জোর করে ধানের জমিতে নীল চাষে কৃষকদের বাধ্য করা- এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই আন্দোলনসমূহের উদ্দেশ্য হলেও সামগ্রিকভাবে এগুলো সবই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলোর মধ্যে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন , চাকমা বিদ্রোহ , তিতুমীরের আন্দোলন , ফরায়েজি আন্দোলন , সিপাহী বিদ্রোহ , নীল বিদ্রোহ , খিলাফত আন্দোলন , অসহযোগ আন্দোলন এবং ভারত ছাড় আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই নিবন্ধ পড়ে আপনি এসব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা লাভের পর সর্বপ্রথম যে বিদ্রোহ হয়েছিল তা ইতিহাসে 'ফকির বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। ফকিররা ১৭৬০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করেছিলেন । ফকিরদের সাথে সন্ন্যাসীরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের সমর্থন কামনা করেন। ফকির-সন্ন্যাসীগণ মীর কাসিমের পক্ষে যুদ্ধও করেছিলেন। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হলেও ফকির-সন্ন্যাসীগণ তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ফকির আন্দোলনের নেতা ছিলেন মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকিরগণ রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকায় ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। মজনু শাহের মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফকির আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৭-১৭৮৭)
১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৬১ সন থেকে নতুন কোম্পানি সরকার বার বার রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৭৭২-৭৩ সাল থেকে চাকমা রাজা জোয়ান বকসকে মুদ্রায় রাজস্ব দিতে বাধ্য করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মুদ্রা অর্থনীতি প্রচলনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে পার্বত্য জীবনে অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৭৭৭ সালে রাজত্বের হার আরও বৃদ্ধি করা হলে প্রধান নায়েব রুনু খান রাজা জোয়ান বকসের সম্মতিক্রমে কোম্পানি বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রুনু খানকে দমন করতে কোম্পানি বার বার সৈন্য প্রেরণ করে কিন্তু প্রত্যেক বার কোম্পানিকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। এভাবে যুদ্ধ চলে প্রায় দশ বছর। অবশেষে কোম্পানি ক্লান্ত হয়ে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজার সাথে সন্ধি স্থাপন করেন।
তিতুমীরের আন্দোলন
তিতুমীর ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীরের প্রকৃত নাম মীর নেছার আলী। তিতুমীর প্রথম বারাসতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি চব্বিশ পরগণার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। তাঁকে দমন করতে প্রেরিত ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ বিদ্রোহ বারাসতের বিদ্রোহ নামে পরিচিত। বারাসতের বিদ্রোহের পর তিতুমীর ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য বুঝতে পেরে নারিকেলবাড়িয়ায় ১৮৩১ সালে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। কোম্পানি সরকার ১৮৩১ সালে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করে। ইংরেজ কামান ও গোলাগুলিতে বাঁশের কেল্লা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। তিতুমীর ও তার চল্লিশ সহচর শহীদ হন। তিতুমীর প্রথম বাঙ্গালী হিসাবে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে শহীদ হন।
ফরায়েজী আন্দোলন
বাংলায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমান সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চরম দুর্দশা নেমে আসে। মুসলমান সমাজের এ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন দেখে যিনি এর সংস্কারের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি হলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, সে আন্দোলন ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। ইসলামের ফরজ পালনের জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ জোর প্রচার চালান। এ ফরয থেকে এ আন্দোলনের নাম ফরায়েজি হয়েছে। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ফরিদপুর জেলা। এছাড়া ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় এ আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মহসিনউদ্দীন ওরফে দুদু মিয়া। 'জমি থেকে খাজনা আদায় আল্লাহর আইনের পরিপন্থী'-খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারদের অত্যাচার রোধকল্পে দুদুমিয়া আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এ উক্তি করেন। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলনের রূপ নেয় সশস্ত্র সংগ্রামে।
সিপাহী বিদ্রোহ
১৮৫৬ সালে 'এনফিল্ড' নামক এক প্রকার বন্দুকের ব্যবহার শুরু হয়। এ বন্দুকের কার্তুজ দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ব্যবহার করতে হত। গুজব রটে যে, এ কার্তুজ শুয়োর ও গরুর চর্বি দিয়ে তৈরি। হিন্দু ও মুসলমান সিপাহীদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, তাদের ধর্ম বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার এ কার্তুজ প্রচলন করে। এ কারণে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি ব্যারাকপুরের এনফিল্ড বন্দুক সিপাহিরা প্রথম বিদ্রোহ করে। ক্রমে তা বহরমপুর ও মীরাটে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ্ণৌ, ঝাঁসি, বেরেলি, অযোধ্যা, রহিলাখণ্ড, কানপুর ইত্যাদি ব্রিটিশ বিরোধী কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিদ্রোহীরা দিল্লি অধিকার করে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবকে 'সিপাহী বিদ্রোহ (Sepoy Rebellion) বলে । এটি ছিল পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত এ সংগ্রাম ব্যর্থ হয়। চার মাস অবরোধের পর বৃটিশগণ দিল্লী দখল করে নেয়। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে (মিয়ানমার) নির্বাসিত করা হয়। ঝাঁসিররাণী লক্ষ্মীবাই যুদ্ধে হয়। ১৮৫৭ সালের ২ মার্চ বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন সিপাহি মঙ্গল পান্ডে।
নীল বিদ্রোহ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সধিত হয় এবং কাপড়ে রং করার জন্য নীলের চাহিদা বেড়ে যায়। এ ব্যবসা ছিল অত্যন্ত লাভজনক। ফলে ইংরেজরা এদেশে নীল চাষ শুরু করে। কিন্তু নীলকররা এদেশের চাষীদের বিভিন্নভাবে ঠকাত। এতে প্রতিবাদ করলে বা নীল চাষে সম্মত না হলে চাষী ও তার পরিবারের উপর চলত অমানুষিক অত্যাচার। নীল চাষীরা তাই প্রথমে সংঘবদ্ধভাবে নীল চাষে অসম্মতি জানায়। এ আন্দোলন ছিল অহিংস। তাদের আবেদন নিবেদন নিষ্ফল হলে আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়। ১৮৫৯-১৮৬০ এ আন্দোলন ফরিদপুর, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, মালদহ, নদীয়া, বারাসত প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার 'নীল কমিশন' (Indigo Commision) গঠন করে। কমিশন সরজমিনে নীলচাষীদের অভিযোগের সত্যতা পায়। ফলে সরকার একটি আইন দ্বারা ঘোষণা করেন যে, নীলকররা বলপূর্বক চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করতে পারবেনা এবং সেটা করলে আইনত দণ্ডনীয় হবে। এ আইন পাসের ফলে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। উল্লেখ্য তৎকালীন নদীয়া, বর্তমানে বাংলাদেশের যশোর জেলায় চৌগাছায় সর্বপ্রথম নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়।
ওয়াহাবী আন্দোলন
আঠার শতকের শেষের দিকে মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক জীবনের অবক্ষয়ের সাথে সাথে শুরু হয় ধর্মীয় ও সামাজিক অধঃপতন। আরবদেশের নেজদের অধিবাসী মুহম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব এক সংস্কার আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। এ আন্দোলন তাঁর নামানুসারে ওহাবী আন্দোলন নামে পরিচিত। কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি দূর করে পবিত্র কুরআন হাদীস নির্দেশিত সরল পথে মুসলিম সমাজকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা তাঁর সংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭)
তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস হতে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। মোট উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, একভাগ পাবে জমির মালিক- এই দাবি থেকে তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত। বাংলার প্রায় ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলন নামে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এ আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন ইলা মিত্র। তেভাগা আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ।
আলীগড় আন্দোলন
অসহযোগ, খেলাফত ও ফরায়েজী আন্দোলন ছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই প্রগতিমূলক ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। আলীগড় আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। ১৮৭৫ সালে উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন, ১৯২০ সালে যা আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা : ১৮৮৫ সালে 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস' বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম। ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা : ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের প্রকৃত নাম ছিল 'নিখিল ভারত মুসলিম লীগ'। মুসলিম লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ, আগা খান এবং নওয়াব ভিকার-উল-মূলুক।
স্বদেশী আন্দোলন
- বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তাকে সাধারণভাবে স্বদেশী আন্দোলন বলে।
- ক) প্রথম পর্যায় : সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দান এবং প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবাদজ্ঞাপন।
- খ) দ্বিতীয় পর্যায় : আত্মশক্তি গঠন ও জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন।
- গ) তৃতীয় পর্যায় : বয়কট বা বিলাতী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার। বয়কট নীতি সফল করতে কৃষ্ণকুমার মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ এবং মতিলাল ঘোষ তাঁদের লেখনী দ্বারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
- ঘ) চতুর্থ পর্যায় : বৈপ্লবিক বা সশস্ত্র আন্দোলন।
বাংলায় সশস্ত্র বৈপ্লবী আন্দোলন
- ১৯০৬ সাল থেকে পরিচালিত এ বৈপ্লবিক আন্দোলনকে ব্রিটিশ সরকার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করে। ঢাকার 'অনুশীলন সমিতি' এবং কলকাতার 'যুগান্তর পার্টি' ছিল বৈপ্লবিক আন্দোলনের দুই প্রধান শক্তিশালী সংগঠন। ঢাকায় 'অনুশীলন সমিতি'র নেতা ছিলেন পুলিন বিহারী দাশ এবং 'যুগান্তর পার্টি'র নেতা ছিলেন বাঘা যতীন (প্রকৃত নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)।
- বিপ্লবীরা ১৯০৮ সালে বাংলার গভর্নর এন্ড্রু ফ্রেজার এবং পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ড। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি বিহারের মোজাফফরপুরে কিং ফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। কিন্তু কিংসফোর্ড গাড়িতে ছিলেন না, ছিলেন অন্য এক ইংরেজের স্ত্রী ও কন্যা। এ বোমায় উভয়ই নিহত হন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন এবং তাঁর ফাঁসি হয়। প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন।
- বঙ্গভঙ্গ রদের পরেও বিপ্লবী আন্দোলন চলতে থাকে। বাংলার সশস্ত্র আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা। এই দুঃসাহসিক অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন স্থানীয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সূর্যসেন যিনি মাস্টার দা নামে পরিচিত। ১৯৩০ সালের ১৮এপ্রিল তিনি তাঁর দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেন। অস্ত্রগার লুণ্ঠনের পর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলীর রেলওয়ে ক্লাব আক্রমণ। ব্রিটিশ সরকার সূর্যসেনসহ অধিকাংশ বিপ্লবীকে ধরতে সমর্থ হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে সূর্যসেনের ফাঁসি হয়।
- ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদঃ ক্ষুদিরাম।
- ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম নারী শহীদঃ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড : ভারতের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন এবং বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ সালে কুখ্যাত ও প্রতিক্রিয়াশীল রাওলাট আইন প্রবর্তন করে। এই আইনের দ্বারা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং যেকোন লোককে নির্বাসন এবং বিনা বিচারে কারাদণ্ড ও নির্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাঞ্জাবে কুখ্যাত রাওলাট আইনের প্রতিবাদে জনগণের শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা ও প্রতিবাদ চলাকালে সরকার গুলি চালিয়ে কিছু লোককে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ান ওয়ালাবাগ উদ্যানে ১০ হাজার মানুষ সমবেত হয়। জেনারেল ডায়ার সমবেত জনগণকে কোনরূপ হুশিয়ারি প্রদান না করে তার সেনাবাহিনীকে গুলি বর্ষনের নির্দেশ দেন। এতে বহুলোক হতাহত হয়। জালিয়ান ওয়ালাবাগ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কাহিনী প্রচারিত হলে সমস্ত ভারতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের দেয়া 'নাইট' উপাধি প্রত্যাখান করেন এর প্রতিবাদে।
লক্ষ্ণৌ চুক্তি : ১৯১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একই সাথে লক্ষ্ণৌ শহরে নিজ নিজ দলের দলীয় সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে উভয় দলের নেতারা ঐতিহাসিক 'লক্ষৌ চুক্তি' স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তি মূলত হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রীতি ও সমঝোতার এক মূল্যবান দলিল।
খিলাফত আন্দোলন
ভারতীয় মুসলমানগণ তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বলে মান্য করত এবং মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক বলে মনে করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটিশ বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়। এতে ভারতের মুসলমানরা পড়ে মহাফাপড়ে। একদিকে তারা ছিল ব্রিটিশ সরকারের অনুগত প্রজা অপরদিকে তুরস্কের সুলতান ছিল তাদের খলিফা। বৃটিশ সরকার মুসলমানদের আশ্বাস দেয় তুরস্কের প্রতি কোন অবিচার করা হবেনা। সরল বিশ্বাসে মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন জোগায়। যুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়ের ফলে ব্রিটিশরা তুরক্ষের ক্ষতি সাধন করে। তুরস্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে মুসলমানদের মনে প্রবল আঘাত হানে। তুর্কী সাম্রাজ্যের অখন্ডতা এবং খিলাফতের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ১৯১৯ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, ড. আনসারী, আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান প্রমুখ যে আন্দোলন শুরু করেন তা খিলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত।
অসহযোগ আন্দোলন
অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের জনক মহাত্মা গান্ধী। রাওলাট আইন ও জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ১৯২০ সালের ১০ মার্চ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এর অর্থ হল ভারতীয়গণ ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবে, অফিস আদালতে কাজ করবে না, ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি বর্জন করবে ইত্যাদি।
অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন
১৯২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন যুগপৎভাবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের চৌচিরা নামক একটি গ্রামে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জনতা থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায়। আন্দোলন অহিংস থাকছেনা বলে গান্ধিজী আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন। অসহযোগ আন্দোলন সমাপ্তির পর খিলাফত আন্দোলনও দূর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় মোস্তফা কামাল তুরস্কের ক্ষমতায় আসেন এবং খিলাফতের অবসান ঘটে। ফলে খিলাফত আন্দোলনেরও সমাপ্তি ঘটে।
- স্বরাজদল ও বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) : চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কংগ্রেসের একাংশ ১৯২৩ সালে স্বরাজ পার্টি গঠন করে। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে স্বরাজ দল কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বরাজদল বাংলার আইন পরিষদে দ্বৈতশাসনব্যবস্থা অচল করার জন্য নির্বাচিত মুসলমান সদস্যদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি বাংলার মুসলমানদের সাথে ১৯২৩ সালে একটি সমঝোতায় পৌছান। এ সমঝোতা বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি নামে পরিচিত। এটি ছিল বাংলায় হিন্দু- মুসলমানদের মিলনের জন্য একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
- সাইমন কমিশন (১৯২৭-৩০) : ১৯২৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারতে আরও রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ৮ সদস্যের একটি বিধিবদ্ধ পার্লামেন্টারি কমিশন গঠন করে। স্যার জন সাইমনকে এ কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এ কমিশনে কোন ভারতীয় প্রতিনিধি ছিল না। ১৯৩০ সালে এই কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করে।
- নেহেরু রিপোর্ট (১৯২৯) : সাইমন কমিশন গঠনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস ভারতবাসীর জন্য উপযোগী শাসন সংস্কারের চেষ্টা চালায়। এ পর্যায়ে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এ রিপোর্ট নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত।
- জিন্নাহর চৌদ্দদফা (১৯২৯) : নেহেরু রিপোর্টের প্রতিবাদে ১৯২৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য ১৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন যা জিন্নাহর চৌদ্দদফা নামে পরিচিত।
আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩২)
গান্ধী ভারতে 'পূর্ণ স্বরাজ্য' প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৩০ সালে আইন অমান্য ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার মারাত্মক নিপীড়নের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করে। ১৯৩২ সালে গান্ধী সত্যাগ্রহ ও আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করে দেন।
ভারত শাসন আইন (১৯৩৫)
- প্রথম দফা গোল টেবিল বৈঠক : ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে সাইমন কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য সরকার ১৯৩০ সালে লন্ডনে 'গোল টেবিল' বৈঠক ডাকেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ বৈঠকে যোদান করেন। জিন্নাহ এই বৈঠকে তাঁর চৌদ্দ দফা পেশ করেন। কংগ্রেস এ বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত থাকে।
- দ্বিতীয় দফা গোল টেবিল বৈঠক : ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করে। কিন্তু গান্ধী ও মুসলমানদের মধ্যে কোন আপোষ না হওয়ায় দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকও ব্যর্থ হয়।
- সাইমন কমিশন ও গোলটেবিল বৈঠকের আলোকে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করা হয়। এই আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ভারত শাসনে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি এবং প্রদেশগুলোর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন।