পানিচক্র যা হাইড্রোলজিক্যাল চক্র নামেও পরিচিত । এটি একটি জৈব ভূ-রাসায়নিক চক্র যা ভূপৃষ্ঠের উপরে এবং নীচে পানির আবর্তন চক্র নিয়ে আলোচনা করে । মূলত পৃথিবীতে পানির মোট পরিমাণ কমেও না আবার বাড়েও না । সৃষ্টির শুরুতে যতটুকু পানি ছিল তা শুধু আবর্তন চক্রের মাধ্যমে কমে এবং বাড়ে । ভূপৃষ্ঠের পানি সূর্য তাপের মাধ্যমে বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে এবং ঠান্ডা বা ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিরুপে ভূপৃষ্ঠে আবার ফিরে আসে । এভাবে ক্রমাগত চক্রাকারে পানির আসা এবং যাওয়ার ফলে পৃথিবীতে পানির সামঞ্জস্য ব্যাহত হয় না। পানিচক্রের বিষয়টি শক্তি রুপান্তরের মতই । শক্তির যেমন কোনো ধ্বংস বা বিনাশ নাই তেমনি পানি ব্যবহারে ও পানির কোনো কমতি বা বাড়তি নাই । আদিকালে পানির পরিমাণ যা ছিল এখনো তাই আছে । শুধু ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমন্ডলে কিছু পানি যায় আবার বৃষ্টিরুপে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে । এ কাজের জন্য সূর্যের আলো বিরাট ভূমিকা রাখে। পানি বাষ্পীভূত হলে চারপাশ শীতল হয় । আবার একই ভাবে বায়ুমন্ডলে জলীয়বাষ্পের ঘনত্ব বাড়লে চারপাশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পানিচক্র সংঘটিত করে মূলত সৌর শক্তি। পৃথিবীতে বাষ্পীভূত হওয়া পানির ৮৬ শতাংশই সমুদ্রের পানি, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা শীতল রাখতে অবদান রাখে।
পানিচক্র
সমগ্র বিশ্বের পানি মূলত অবিরাম একটি চক্রের মধ্যে দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে । হয়তো কোথাও পানি সূর্য তাপে বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশছে আবার একই সময়ে কোথাও বৃষ্টিরুপে পানি ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসছে । শুধু সূর্য তাপের মাধ্যমেই যে পানি বায়ুমন্ডলে মিশছে বিষয়টি এমন নয় । আমরা উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় দেখি পাতার সাহায্যে উদ্ভিদ তার শরীরের পানি বের করে দিচ্ছে । এভাবে ও পানি বায়ুমন্ডলে মিশছে । বিভিন্নভাবে পানি সর্বদা আবর্তিত হচ্ছে এবং অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। এর আরো একটি কারণ হল পানি বাষ্পীয়, তরল ও কঠিন এ তিন অবস্থায় থাকতে পারে। মেরু অঞ্চলের পানির বেশিরভাগই বরফরুপে অবস্থান করছে । তবে এ ক্ষেত্রে সূর্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পানির সুবিশাল উৎস হচ্ছে সমুদ্র । সূর্যের তাপে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে সমুদ্রের পানি উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে বাষ্পাকারে উপরে ওঠে এবং সুবিশাল বায়ুমন্ডলে মিশে যায়। জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু শীতল ও ঘনীভূত হয়ে মেঘ, বৃষ্টি, শিশির, কুয়াশা, তুষার, বরফ প্রভৃতিতে পরিণত হয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। বিভিন্ন উপায়ে ভূপৃষ্ঠে পতিত পানির কিছু অংশ বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পুনরায় বায়ুমন্ডলে মিশে যায়, কিছু অংশ নদী দ্বারা বাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়, কিছু অংশ উদ্ভিদ অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় (Osmosis) গ্রহণ করে এবং অবশিষ্টাংশ ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরের মধ্যে চুয়ে প্রবেশ করে। এভাবেই প্রকৃতিতে পানিচক্র চলতে থাকে । সংক্ষেপে , পানি বিভিন্ন অবস্থায় ( কঠিন / তরল / বায়বীয় ) ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমন্ডলে , আবার বায়ুমন্ডল থেকে ভূপৃষ্ঠে ক্রমাগত ফিরে আসার এই মহা আবর্তনকেই পানিচক্র বলে । পানিচক্রের প্রক্রিয়াগুলোর বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো :
১) বাষ্পীভবন (Evaporation) :
সূর্য পৃথিবীকে তার আলোর সাথে প্রচুর তাপ এবং শক্তি সরবরাহ করে। সূর্যের আলো পৃথিবীর পৃষ্ঠকে ভালোভাবে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকারের তাপ সরবরাহ করে, যার মধ্যে পানির উপরের তাপ দ্বারা পানি বাষ্পীভবনের প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত। সূর্যের তাপে সমুদ্র, নদী, হ্রদ , খাল বিল , পুকুর অর্থাৎ যেখান থেকেই পানি শোষণ করা যায় তা হতে পারে ভেজামাটি থেকে শুরু মহাসমুদ্র প্রভৃতি থেকে পানি ক্রমাগত বাষ্পে পরিণত হচ্ছে এবং তা অপেক্ষাকৃত হালকা হয়ে উপরে উঠে বায়ুমণ্ডলে মিশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। একে বাষ্পীভবন বলে। বায়ুর বাষ্প ধারণ করার একটা সীমা আছে। তা বায়ুর উষ্ণতার উপর নির্ভর করে। বায়ু যত উষ্ণ হয়, তত বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে। সমুদ্রই জলীয়বাষ্পের প্রধান উৎস। উদ্ভিদজগৎ , নদ-নদী এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয় , পানি আছে এমন যে কোনো কিছু থেকেও সূর্যতাপের মাধ্যমে বায়ু জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে থাকে।
২) ঘনীভবন (Condensation) :
পানির ঘনীভবন প্রক্রিয়া বস্তুত পানির বাষ্পীভবনের বিপরীতে ঘটে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে বাষ্পীভূত পানি ঠান্ডা বা ঠাণ্ডা পরিবেশে পরিণত হয় এবং ঘনীভূত পদার্থত্ত্বের অবস্থায় পরিণত হয়। বাষ্পীভবনের পর জলীয়বাষ্প বায়ুমন্ডলে থাকা অবস্থায় তাপমাত্রা কমতে থাকে , তখন তার অণুবিশেষ যা বাষ্পীভূত অবস্থা থেকে পানি অবস্থায় আসে , এই প্রক্রিয়াটি সাধারণভাবে ঘনীভবন বা 'শীতলীকরণ' বা 'কনডেনসেশন' নামে পরিচিত। মূলত বায়ু উষ্ণতর হলে তখন এটি আরও বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে। আবার বায়ু শীতল হতে থাকলে পূর্বের মতো বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করে রাখতে পারে না, তখন জলীয়বাষ্পের কিছু অংশ পানিতে পরিণত হয়, তাকে ঘনীভবন বলে। বায়ু যে উষ্ণতায় (জলীয়বাষ্পীরূপে) ঘনীভূত হয় তাকে শিশিরাংক (Dew point) বলে। তাপমাত্রা ০০ সেলসিয়াস বা হিমাঙ্কের (Freezing point) নিচে নেমে গেলে তখন ঘনীভূত জলীয়বাষ্প কঠিন আকার ধারণ করে এবং তুষার ও বরফরূপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। কিন্তু হিমাঙ্ক শিশিরাঙ্কের উপরে থাকলে ঘনীভবনের মাধ্যমে শিশির, কুয়াশা অথবা বৃষ্টিতে পরিণত হয়। আর এভাবেই পানি আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে ।
বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারনের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে । কিন্তু বায়ুর উষ্ঞতা বৃদ্ধি পেলে তার জলীয়বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কোনো নির্দিষ্ট উষ্ণতায় বায়ু যে পরিমাণ জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে, সেই পরিমাণ জলীয়বাষ্প বায়ুতে থাকলে বায়ু আর অধিক জলীয়বাষ্প গ্রহণ করতে পারে না। তখন তাকে সম্পৃক্ত বা পরিপূক্ত বায়ু (Saturated air) বলে।
৩) বারিপাত (Precipitation) :
জলীয়বাষ্প উপরে উঠে শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা ও তুষারকণায় পরিণত হয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। একে বারিপাত বলে। সকল প্রকার বারিপাত এই জলীয়বাষ্পের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি অনুযায়ী বারিপাত বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা— তুষার, তুহিন, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি।
শিশির (Dew) : ভূপৃষ্ঠ তাপ বিকিরণের মাধ্যমে রাতে শীতল হয়। এ সময় ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। ফলে বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র জলবিন্দুরূপে ভূপৃষ্ঠে সঞ্চিত হয়। এটাই শিশির নামে পরিচিত।
কুয়াশা (Fog) : কখনো কখনো বায়ুমণ্ডলের ভাসমান ধূলিকণাকে আশ্রয় করে জলীয়বাষ্প রাত্রিবেলায় অল্প ঘনীভূত হয়ে ধোঁয়ার আকারে ভূপৃষ্ঠের কিছু উপরে ভাসতে থাকে। একে কুয়াশা বলে।
তুষারপাত (Snow fall) : শীতপ্রধান এলাকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামলে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পেঁজা তুলার ন্যায় ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। একে তুষারপাত বলে ।
৪) পানিপ্রবাহ (Run off) :
বারিপাতের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে আগত পৃষ্ঠপ্রবাহ পানিরূপে নদী, হ্রদ ও সমুদ্রে পতিত হয়। আবার ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে অন্তঃপ্রবাহরূপে নদী ও সমুদ্রে জমা হয়। পানির কিছু অংশ ভূগর্ভে জমা হয়। পানিপ্রবাহকে আবার কতকগুলো ভাগে ভাগ করা যায়।
- পৃষ্ঠপ্রবাহ (Surface flow)
- অন্তঃপ্রবাহ (Subsurface Flow)
- চুয়ানো (Percolation)
- পরিস্রবণ (Infiltration)
ভূঅভ্যন্তরস্থ পানি পুনরায় প্রস্বেদন, বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় বায়ুতে ফিরে আসে।