আমরা নাস্তায় রুটি, মুড়ি, চিড়া, পাঁউরুটি ইত্যাদি খাই। এগুলো শর্করা জাতীয় খাদ্য। শর্করা শক্তি উৎপাদনকারী খাদ্য। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে শর্করার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। শর্করা সহজপাচ্য। সব শর্করাই কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এই তিনটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। শর্করা দেহের কর্মক্ষমতা বোপায়। গ্লুকোজ এক ধরনের সরল শর্করা। শর্করা, স্নেহ ও আমিষের মধ্যে শর্করা সর্বাপেক্ষা সহজপাচ্য। দেহে শোষিত হওয়ার পর শর্করা খুব কম সময়ে তাপ উৎপন্ন করে দেহে শক্তি যোগায়। ১ গ্রাম শর্করা ৪ কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন করে। মানবদেহে প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রাম শর্করা জমা থাকতে পারে। এ পরিমাণ শর্করা ১২০০-১৬০০ কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন করে দেহের শক্তি যোগায়। বয়স, দেহের ওজন, উচ্চতা, পরিশ্রমের মাত্রার উপর শর্করার চাহিদা নির্ভর করে। একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের দৈনিক শর্করার চাহিদা তার দেহের প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের ৪.৬ গ্রাম হয়ে থাকে। একজন ৬০ কেজি ওজনের পুরুষ মানুষের গড়ে দৈনিক শর্করার চাহিদা = (৬০×৪.৬) গ্রাম বা ২৭৬ গ্রাম। আমাদের মোট প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা ৬০-৭০ ভাগ শর্করা হতে গ্রহণ করা দরকার।
শর্করার শ্রেণিবিভাগ
রাসায়নিক গঠনপদ্ধতি অনুসারে সব শর্করাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। একটি মাত্র শর্করা অণু দিয়ে গঠিত হয় মনোস্যাকারাইড। একে সরল শর্করাও বলে। দ্বি-শর্করা ও বহু শর্করা পরিপাকের মাধ্যমে সরল শর্করায় পরিণত হয়ে দেহের শোষণযোগ্য হয়। মানবদেহ পরিপুষ্টির জন্য সরল শর্করা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানবদেহ শুধুমাত্র সরল শর্করা গ্রহণ করতে পারে। গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, গ্যালাকটোজ এ তিনটি শর্করার মধ্যে গ্লুকোজ রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে পরিবাহিত হয়।
সকল কার্বোহাইড্রেট কার্বন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একপ্রকার জৈব যৌগ যার মধ্যে কার্বনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে শর্করা তিন প্রকার, যথা-
১. মনোস্যাকারাইড: শর্করা জগতে এরা সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক। যাদের আর্দ্র বিশ্লেষণ বা পানি বিয়োজন করলে অন্য কোন শর্করা পাওয়া যায় না, তাকে মনোস্যাকারাইড বলে। এটি এক মনোমার বিশিষ্ট শর্করা । যেমনঃ গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাকটোজ।
২. ডাইস্যাকারাইডঃ যে শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ বা পানি বিয়োজন করলে ২টি মনোস্যাকরাইড পাওয়া যায়, তাকে ডাইস্যাকারাইড বলে। এটি দুই মনোমার বিশিষ্ট শর্করা । যেমন: সুক্রোজ, ল্যাক্টোজ, ম্যালটোজ ইত্যাদি।
- ১ অণু সুক্রোজ = ১ অণু গ্লুকোজ + ১ অণু ফ্রুক্টোজ।
- ১ অণু ম্যালটোজ = ২ অণু গ্লুকোজ
- ১ অণু ল্যাকটোজ = ১ অণু গ্লুকোজ + ১ অণু গ্যালাকটোজ
৩. ওলিগোস্যাকারাইডঃ যে শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ বা পানি বিয়োজন করলে ৩ থেকে ১০টি মনোস্যাকারাইড পাওয়া যায় তাকে ওলিগোস্যাকারাইড বলে। যেমনঃ ম্যালটোট্রায়োজ, র্যাবিনোজ ইত্যাদি।
৪. পলিস্যাকারাইডঃ যে শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ বা পানি বিয়োজন করলে করলে ১০টির অধিক মনোস্যাকারাইড পাওয়া যায়, তাকে পলিস্যাকারাইড বলে। এটি বহু মনোমার বিশিষ্ট শর্করা । যেমন: গ্লাইকোজেন, স্টার্চ, সেলুলোজ ইত্যাদি। মূলত ওলিগোস্যাকারাইড এবং পলিস্যাকারাইড একই । কারণ উভয়ই দুইয়ের অধিক মনোমার বিশিষ্ট শর্করা ।
স্বাদের ভিত্তিতে শর্করা দুই প্রকার, যথা- সুগার এবং ননসুগার । সকল মনোস্যাকারাইড এবং অলিগোস্যাকারাইড শর্করা হলো সুগার শর্করা । যেমনঃ গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাক্টোজ, সুক্রোজ ইত্যাদি। আবার সকল প্রকার ননসুগার শর্করা হলো পলিস্যাকারাইড শর্করা । যেমনঃ স্টার্চ, সেলুলোজ ইত্যাদি।
বিজারণ ক্ষমতার ভিত্তিতে সকল শর্করা ২ প্রকার যথা- বিজারক শর্করা এবং অবিজারক শর্করা ।
শর্করার অভাবজনিত রোগ
আহারে কম বা বেশি শর্করা গ্রহণ উভয়ই দেহের জন্য ক্ষতিকর। শর্করার অভাবে অপুষ্টি দেখা দেয়। রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে গেলে দেহে বিপাক ক্রিয়ার সমস্যা সৃষ্টি হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গেলে হাইপোগ্লাইমিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন- ক্ষুধা অনুভব করা, বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ঘামানো, হৃৎকম্পন বেড়ে বা কমে যাওয়া।
শর্করার উৎস
- শ্বেতসার বা স্টার্চ: চাল, গম, ভুট্টা ও অন্যান্য দানা শস্য স্টার্চের প্রধান উৎস। এ ছাড়াও আলু, রাঙা আলু ও কচু,আখ ইত্যাদি এর প্রধান উৎস।
- গ্লুকোজ: এটি চিনির তুলনায়, মিষ্টি কম। এই শর্করাটি আঙুর, আপেল, গাজর, খেজুর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়।
- ফ্রুকটোজ: আম, পেঁপে, কলা, কমলালেবু প্রভৃতি মিষ্টি ফলে ফুলের মধুতে থাকে।
- সুক্রোজ: আখের রস, চিনি, গুড়, মিসরি এর উৎস।
- সেলুলোজ: বেল, আম, কলা, তরমুজ, বাদাম, শুকনা ফল এবং সব ধরনের শাক সবজিতে থাকে।
- ল্যাকটোজ বা দুধ শর্করা : গরু, ছাগল ও অন্যান্য প্রাণীর দুধে থাকে।
- গ্লাইকোজেন : পশু ও পাখি জাতীয় মুরগি ,কবুতর যকৃৎ ও মাংসে থাকে।
তথ্য কণিকা
- গ্লুকোজের রাসায়নিক সংকেত: C6H12O6
- গ্লুকোজের স্থুলসংকেত: CH2O
- ইক্ষুচিনি বা বিটাচিনির রাসায়নিক নাম: সুক্রোজ।
- অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য উদ্ভিদ দেহে কি হিসাবে জমা থাকে: স্টার্চ।
- অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রাণীদেহে কি হিসাবে জমা থাকে: গ্লাইকোজেন।
- গ্লাইকোজেন কোথায় জমা থাকে: যকৃতে (Liver)।
- শর্করা জাতীয় খাদ্যের উৎস: চাল, আটা, আলু, ভুট্টা, চিনি, গুড়, মধু, সবজি ইত্যাদি।
- সিদ্ধ চালে কি পরিমাণ শ্বেতসার থাকে: চাল একটি শ্বেতসার জাতীয় পদার্থ। সিদ্ধ চাল সহজপাচ্য একটি শর্করা/শ্বেতসার উৎস। সিদ্ধাচালের ৭৯% শ্বেতসার পদার্থ থাকে।
- দুধের শ্বেতসার অংশকে ল্যাকটোজ বলে ।
- দুধকে জমাট বাঁধায়: রেনিন।
- দুধ ফেটে যায় কেন: সদ্য দোহন করা দুধের অম্লের পরিমাণ কম থাকে। এ অবস্থায় বেশিক্ষণ রাখলে দুধের ল্যাকটোজ উপাদানটি ল্যাকটিক এসিডে পরিণত হয়। ফলে দুধের অম্লের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং দুধ ফেটে যায়।
- বাংলাদেশের গুঁড়া দুধের জন্য তেজস্ক্রিয়তার গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা: বাংলাদেশে গুঁড়া দুধের জন্য তেজস্ক্রিয়তার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে ৩০০ বিকিউ। এ মাত্রা দ্বারা বোঝা যায় এক কিলোগ্রাম গুঁড়া দুধে প্রতি সেকেন্ডে ৩০০টি করে পরমাণু ভাঙতে থাকে।
- পাস্তুরায়ন: কোনো পদার্থ বিশেষ করে দুধকে জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়াকে পাস্তুরায়ন বলে। পাস্তুরায়ন অর্থ আংশিক নির্জীব। দুধকে ৩০ মিনিট ধরে 145° থেকে 150° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে হঠাৎ 50° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনলে দুধ জীবাণুমুক্ত হয়। বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন বলে এর নাম পাস্তুরায়ন।
- মানবদেহে সেলুলোজ পরিপাক হয়না কেন: মানবদেহের অন্ত্রে সেলুলোজ পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক নেই।
- সেলুলোজ জাতীয় খাবার গ্রহণের গুরুত্ব: কোষ্টকাঠিন্য দূর হয়।
- ফ্রুক্টোজ সুগারের জন্য পাকা আম মিষ্টি হয়। আর পাকা যেকোন ফলেই এই কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। এর স্বাদ হলো মিষ্টি। কিন্তু, কাঁচা আমে বিভিন্ন জৈব এসিড থাকে যেমনঃ সাক্সিনিক এসিড, ম্যালিক এসিড ইত্যাদির উপস্থিতি থাকে যার ফলে কাঁচা আম খেতে টক লাগে।
- মায়ের দুধে গরুর দুধের চাইতে কার্বোহাইড্রেট উপাদান বেশি থাকে। মায়ের দুধ ও গরুর দুধে কার্বোহাইড্রেট (ল্যাকটোজ) এর পরিমাণ যথাক্রমে ৭.৯% ও ৪.৮%। অন্যদিকে মায়ের দুধ ও গরুর দুধে ফ্যাট ও প্রোটিনের পরিমাণ যথাক্রমে ৩.৭% ও ৩.৮% এবং ১.২৫% ও ৩.৫%।
- খাদ্যের হজম প্রক্রিয়াকে পরিপাক বলে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্যের জটিল পুষ্টি উপাদান যেমন- শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, আমিষ বা প্রোটিন এবং চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাদ্যগুলো ভেঙে সরল ও দ্রবণীয় হয়ে দেহে শোষিত হয় তাকে পরিপাক ক্রিয়া বলে। প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের পরিপাক শুরু হয় পাকস্থলী থেকে। শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের পরিপাক শুরু হয় মুখবিবর থেকে।