উদ্ভিদের জন্য পুষ্টি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এগুলো তাদের বেঁচে থাকতে এবং সুষমভাবে বেড়ে ওঠতে সহায়তা করে । প্রধানত, উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান হলো অ্যামিনো অ্যাসিড, কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, বরিয়াম, ক্লোরিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, কোবাল্ট, মোলিবডেনাম এবং সিলিকন। প্রত্যেক পুষ্টি উপাদানের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার উদ্ভিদের জন্য প্রায়ই বিভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালসিয়াম- পাতা এবং স্নায়ুজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ফসফরাস বীজপোষক উপাদান হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও, প্রাইমারি পুষ্টি উপাদান যেমন নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস প্রধানত উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজন । সাধারণত, কোন একটি পুষ্টি উপাদানের অভাবে একটি উদ্ভিদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় । এই অভাব সমাধান করার জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যেমন উদ্ভিদের জন্য সামান্য পুষ্টি সাপেক্ষে সার প্রয়োগ এবং ফলনের উন্নতি করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার। পুষ্টি উপাদান প্রাপ্তির উপায় বিভিন্ন হতে পারে, যেমন মাটি, জল, বায়ু , পর্যাপ্ত আলো, সার ইত্যাদি । সংক্ষেপে, উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান খুবই প্রয়োজনীয় যা তাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উদ্ভিদের পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ১৬টি। উদ্ভিদের প্রয়োজন অনুযায়ী এদেরকে আবার দুইভাগে ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ ক) ম্যাক্রোমৌল খ) মাইক্রোমৌল
মুখ্য উপাদান বা ম্যাক্রোমৌল : যে সমস্ত উপাদান গাছের জন্য অধিক প্রয়োজন হয় সেগুলোকে মুখ্য উপাদান বা ম্যাক্রোমৌল বলে। উদ্ভিদের মুখ্য উপাদান দশটি। যথা- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার বা গন্ধক এবং লৌহ। এর মধ্যে কার্বন ও অক্সিজেন উদ্ভিদ বায়ু হতে গ্রহণ করে এবং হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পানি হতে গ্রহণ করে । অবশিষ্ট সবগুলো উদ্ভিদ মাটি থেকে গ্রহণ করে । কচুশাকে লৌহ রয়েছে। ক্লোরোফিল অণুর উপাদান ম্যাগনেশিয়াম । লিগিউমেনাস গোত্রের উদ্ভিদের মূলে নডিউল সৃষ্টিতে সাহায্য করে সালফার। নাইট্রোজেন উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য দ্বায়ী। যেহেতু ইউরিয়া সারে নাইট্রোজেন থাকে তাই ইউরিয়া সার ও উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য দ্বায়ী।
গৌণ উপাদান বা মাইক্রোমৌল : যে সমস্ত খাদ্যোপাদান উদ্ভিদের জন্য খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয় সেগুলোকে গৌণ উপাদান বা মাইক্রোমৌল বলে। উদ্ভিদের গৌণ উপাদান ছয়টি। যথা- ম্যাংগানিজ, মলিবডেনাম, তামা বা কপার , দস্তা, বোরন এবং ক্লোরিন । এ সবগুলো উপাদান উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের সাহায্যে গ্রহণ করে ।
এ ছাড়াও কিছু পুষ্টিদায়ক পদার্থ সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় যেমন- নিকেল, কোবাল্ট, সোডিয়াম, সিলিকন, সেলেনিয়াম , ভেনাডিয়াম ইত্যাদি । তবে এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সব পুষ্টি উপাদানগুলিই সব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়, কয়েকটির ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয়, এমন উপাদানগুলির ক্ষেত্রে উপকারী এবং অপরিহার্যের মধ্যে তফাৎ করাটা কঠিন। যেমন, কোবাল্ট কলাই শস্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ স্থির রাখতে সাহায্য করে। দেখা গেছে, উদ্ভিদের তাপ ও খরা পরিস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায় কোষের দেওয়ালে জমে থাকা সিলিকন। পাশাপাশি সিলিকন কীটপতঙ্গ ও ছত্রাকের আক্রমণ থেকেও উদ্ভিদকে রক্ষা করে। সিলিকন একটি উপকারী পদার্থ হিসেবে অতিরিক্ত ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, ফসফরাস ও অ্যালুমিনিয়ামের বিষক্রিয়া রোধ করে। দস্তার অভাবও পূরণ করে। উদ্ভিদের পুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়টিকে যদি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা যায়, তা হলে একে কখনওই অপরিহার্য পুষ্টিদায়ক পদার্থ নিয়ে আলোচনার মধ্যে বেঁধে রাখা যাবে না। এর মধ্যে যাবতীয় উপকারী উপাদানগুলিকেও রাখতে হবে, কারণ সেগুলোকে বাদ দিয়ে উদ্ভিদের সুষম বেড়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণসমূহ
গাছ বা ফসলের খাদ্যোপাদানের অভাবে ইহার গঠন, আকৃতি ও পাতায় নানারকম লক্ষণ প্রকাশ পায়। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হল-
(ক) নাইট্রোজেনের অভাবে-
- ক্লোরোফিল সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটে এবং প্রথমে গাছের পাতা হালকা সবুজ রং ধারণ করে এবং পরে তা হলুদ রঙে পরিণত হয়। একে ক্লোরোসিস বলে।
- অনেক গাছের পাতা ঝরে যায়, পার্শ্বকুড়ি শুকিয়ে যায় এবং ফল যথেষ্ট পরিমাণে কম ধরে।
- কোষের বৃদ্ধি হয় না, বিভাজন কমে যায়, ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ফলে ইহা খর্বাকৃতির হয়।
(খ) ফসফরাসের অভাবে-
- চারাগাছ গাঢ় সবুজ ও ফ্যাকাশে গোলাপী / বেগুনী রং ধারণ করে, পরে তা হলদে রঙে রূপান্তরিত হয়।
- মূলের বৃদ্ধি কমে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
- ফসল পাকতে ও ফলের বীজে পরিণত হতে বিলম্ব ঘটে।
- পাতা, ফুল ও ফল অপরিণত অবস্থায় ঝরে পড়ে; পাতা ও ফলে বাদামি দাগ পড়ে ।
(গ) পটাশিয়ামের অভাবে-
- প্রায় গাছেই পোড়ানো ঝাঁঝাল পাতা দেখা যায়।
- ক্রমান্বয়ে পাতার শীর্ষ ও কিনারায় হলুদ দাগ দেখা দেয় এবং পরিশেষে শুকিয়ে কোঁকড়াইয়া মৃত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
(ঘ) ক্যালসিয়ামের অভাবে-
- পাতার শীর্ষভাগ বিকৃতভাবে গঠিত হয় এবং পরিশেষে তাতে পচন দেখা যায়।
- পাতার কিনারা ও দুই শিরার মাঝখানে হলুদ ও বাদামী রঙের সৃষ্টি হয়।
(ঙ) ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে-
- বয়স্ক পাতা প্রথমে হলুদ হয়। পাতার দুটি শিরার মধ্যবর্তী অঞ্চল হলুদ হয়। পাতায় মৃত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
- জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে পাতা ঝরে যায়।
(চ) লৌহের অভাবে-
- প্রথমে কচি পাতার রঙ হালকা হয়ে যায় তবে সরু শিরার মধ্যবর্তী স্থানেই প্রথমে হালকা হয়। কখনও কখনও সম্পূর্ণ পাতা বিবর্ণ হয়।
- সয়াবিন, কমলালেবু এবং সবজি জাতীয় গাছের পাতায় পচন ধরে।
- খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় পাতা একেবারে সাদা হয়ে যায়।
(ছ) সালফারের অভাবে-
- গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং কাণ্ড কৃশ ও খর্বাকৃতি হয়ে যায়।
- কোন কোন গাছে নিচের পাতা গাঢ় লাল রং ধারণ করে।
(জ) ম্যাঙ্গানিজের অভাবে-
- গাছ বামনাকৃতি প্রাপ্ত হয়।
- গাছে ফুল ও ফল ধরতে বিলম্ব ঘটে।
(ঝ) মলিবডেনামের অভাবে-
- ফুল কপিতে আশ্চর্যজনক বিকৃতি ঘটে। এই বিকৃতি ঘটিত রোগকে 'হুইপ টেইল' বলে।
- গাছ লম্বা হয়ে বিদঘুটে দেখায়।
(ঞ) বোরনের অভাবে -
- মূলের বৃদ্ধি কমে যায়, শাখার শীর্ষ মরে যায়, ফুলের কুড়ি জন্ম ব্যাহত হয়।
(ট) জিংকের অভাবে -
- উদ্ভিদের পাতার আকার হ্রাস পায়।
মটর গাছে গুটি হয় কেন? মটর একটি ডালজাতীয় গাছ। আর এ ডাল জাতীয় গাছ প্রোটিন তৈরি করে, যে প্রোটিনে নাইট্রোজেন থাকে। মটর জাতীয় গাছের নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় যা সরাসরি বায়ু থেকে গ্রহণ করতে পারে না। মটর জাতীয় গাছের শিকড়ে গুটি তৈরি হয়। এ গুটিতে বাস করে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যার মধ্যে অন্যতম রাইজোবিয়াম। এ রাইজোবিয়াম বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে অক্সিজেনের সাহায্যে নাইট্রোজেন যৌগ গঠন করে যা উদ্ভিদ গ্রহণ করে থাকে।
কোন ধরনের উদ্ভিদ বায়ু থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে? শিম জাতীয় উদ্ভিদ বায়ু থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন সংগ্রহ করতে পারে। শিম, মটরশুটি, ছোলা ইত্যাদি উদ্ভিদের মূলে সিমবায়েটিক জীবাণু 'রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া' গুটি বা নুডুল তৈরি করে সরাসরি বায়ুস্থ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে।