দেহকোষ ও দেহের তরল অংশের জন্য খনিজ লবণ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। শরীর গঠনে আমিষের পর খনিজ লবণের অবস্থান । মানুষের শরীরে ক্যালসিয়াম, লৌহ, সালফার, দস্তা, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়োডিন ইত্যাদি থাকে। এ উপাদানগুলো কখনো মৌলিক উপাদানরূপে মানবদেহে অবস্থান করে না, এগুলো খাদ্য ও মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে অন্য পদার্থের সাথে মিলিত হয়ে নানা জৈব এবং অজৈব যৌগের লবণ তৈরি করে। খনিজ লবণ দেহ গঠন ও দেহের অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। হাড়, দাঁত, পেশি, এনজাইম এবং হরমোন গঠনের জন্য খনিজ লবণ একটি অপরিহার্য উপাদান। স্নায়ুর উদ্দীপনা, পেশি সংকোচন, দেহকোষে পানির সাম্যতা বজায় রাখা, অম্ল ও ক্ষারের সমতাবিধান, এসব কাজে খনিজ লবণের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মানবদেহে শতকরা চার ভাগ খনিজ লবণ থাকে ।

খনিজ লবণের উৎস
খনিজ লবণের উৎস। খনিজ লবণের প্রধান উৎস সবুজ শাকসবজি। দুধ, দই, ছানা, পনির, ছোট মাছ (মলা-ঢেলা), নানা রকম ডাল, সবুজ শাকসবজি, ঢেঁড়স, লাল শাক, কচু শাক ইত্যাদি ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস। কলিজা, সবুজ শাকসবজি, মাংস, ডিমের কুসুম, কচু শাক ইত্যাদিতে লৌহ থাকে। দুধ, মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়। খাবার লবণ, চিপস, নোনতা খাবার, পনির, বাদাম, আচার ইত্যাদিতে সোডিয়াম থাকে। মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল, কলা, আলু, আপেল ইত্যাদিতে পটাশিয়াম থাকে। আয়োডিনের উৎস হলো সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছ, মাংস এবং শেওলা। প্রাণীরা প্রধানত উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করে খনিজ পদার্থ পায়। আমরা শাকসবজি, ফল-মূল, দুধ, ডিম, মাছ এবং পানীয় জলের মাধ্যমে আমাদের খনিজ লবণের চাহিদা পূরণ করি।
এক নজরে কিছু খনিজ লবণের নাম ও অভাব জনিত সমস্যাঃ
খনিজ লবণের নাম | অভাব জনিত সমস্যা |
---|---|
আয়োডিন | গলগন্ড |
আয়রন | রক্তশূন্যতা |
জিংক | বন্ধ্যাত্ব, বুদ্ধিহীনতা |
ক্যালসিয়াম | শিশুদের রিকেটস , বয়স্ক নারীদের অস্টিওম্যালাসিয়া |
সোডিয়াম | হৃদরোগ |
পটাশিয়াম | পেশি দুর্বলতা |
ফসফরাস | হাড়ক্ষয় |
লৌহ (Fe)
লৌহ রক্তের একটি প্রধান উপাদান। প্রতি ১০০ ml রক্তে লৌহের পরিমাণ প্রায় ৫৫০ mg। যকৃত, প্লীহা, অস্থি মজ্জা এবং লোহিত রক্ত কণিকায় এটি সঞ্চিত থাকে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে লোহার পরিমাণ ২-৬ গ্রাম।
উৎস: লৌহের উদ্ভিজ্জ উৎস হচ্ছে ফুলকপির পাতা, নটে শাক, নিম পাতা, ডুমুর, কাঁচা কলা, ভূট্টা, গম, বাদাম, বজরা ইত্যাদি। কচুশাকে লৌহের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । এ কারণে কচুশাক আয়রন বা লৌহের অন্যতম প্রধান উৎস। প্রাণিজ উৎস হচ্ছে মাছ, মাংস, ডিম, যকৃৎ ইত্যাদি।
কাজ: লৌহের প্রধান কাজ হিমোগ্লোবিন গঠনে সাহায্য করা। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তশূন্যতা রোগ হয়। রক্ত শূন্যতা রোগের লক্ষণ চোখ ফ্যাকাসে হওয়া, হাত পা ফোলা, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি।
অভাবজনিত রোগ : লোহার অভাবজনিত রোগ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া । আয়রন বা লৌহ রক্তের হিমোগ্লোবিনের অন্যতম প্রধান উপাদান। এর অভাবে হিমোগ্লোবিন এর উৎপাদন কম হয় । আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতার লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ফ্যাকাশে ত্বক, ভঙ্গুর নখ এবং একটি কালশিটে বা মসৃণ জিহ্বা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে, এটি হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতা, শিশুদের বিকাশে বিলম্ব এবং সংক্রমণের ঝুঁকির মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ক্যালসিয়াম (Ca)
এটি প্রাণী দেহের হাড় ও দাঁতের একটি প্রধান উপাদান। মানুষের শরীরের মোট ওজনের শতকরা ২ ভাগ হচ্ছে ক্যালসিয়াম। খনিজ পদার্থের মধ্যে দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । অস্থি এবং দাঁতে ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে এর ৯০% শরীরে সঞ্চিত থাকে এবং লসিকাতে এর উপস্থিতি লক্ষণীয়।
উৎস: ক্যালসিয়ামের উদ্ভিজ্জ উৎস হলো ডাল, তিল, সয়াবিন, ফুলকপি, গাজর, পালং শাক, কচুশাক, লালশাক, কলমি শাক, বাঁধাকপি এবং ফল। প্রাণিজ উৎস হচ্ছে দুধ, ডিম, ছোট মাছ, শুটকি মাছ ইত্যাদি।
কাজ: হাড় এবং দাঁতের গঠন শক্ত রাখার জন্য ক্যালসিয়াম একটি অতিপ্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এছাড়া ক্যালসিয়াম এবং স্নায়ু ও পেশীর সঞ্চালনে সাহায্য করে।
অভাবজনিত রোগ: ক্যালসিয়াম অভাবে শিশুদের রিকেটস এবং বয়স্ক নারীদের অস্টিওম্যালেসিয়া রোগ হয়। এর অভাবে শিশুদের দাঁত উঠতে দেরি হয় এবং তাদের রক্ত সঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটে।
ফসফরাস (P)
দেহে পরিমাণের দিক থেকে খনিজ লবণগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরই ফসফরাসের স্থান। ফসফরাসও ক্যালসিয়াম এর মত হাড়ের একটি উপাদান। ফসফরাস হাড়, যকৃৎ, এবং রক্তরসে সঞ্চিত থাকে। নিউক্লিক এসিড, নিউক্লিও প্রোটিন তৈরি এবং শর্করা বিপাকের দ্বারা শক্তি উৎপাদনের প্রধান ভূমিকা রাখে। মানুষের শরীরে বেশির ভাগ ফসফেট রয়েছে হাড়ে ।
উৎস: ফসফরাসের উদ্ভিদ উৎস হচ্ছেঃ দানা শস্য, শিম, বরবটি, মটরশুঁটি, বাদাম ইত্যাদি। প্রাণিজ উৎস হচ্ছেঃ ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, কলিজা ইত্যাদি।
কাজ: ক্যালসিয়ামের মতো হাড় ও দাঁত গঠন করা ফসফরাসের প্রধান কাজ।
অভাব জনিত রোগ: ফসফরাসের অভাবে রিকেটস, অস্থিক্ষয়, দন্তক্ষয়- এসব রোগ দেখা দেয়। খাবারের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম থাকলে ফসফরাসের অভাব হয় না।
আয়োডিন
- কোন হরমোন তৈরিতে আয়োডিনের প্রয়োজন হয়: থাইরয়েড।
- আয়োডিনের উৎস: সামুদ্রিক উদ্ভিদ, সামুদ্রিক মাছ, কডলিভার তেল, সমুদ্র উপকূলে চরানো গরুর দুধ ও মাংস, বাঁধাকপি প্রভৃতি আয়োডিনের প্রধান উৎস। বর্তমানে আয়োডিন যুক্ত লবন আয়োডিনের অন্যতম উৎস।
- আয়োডিনের অভাবে কি রোগ হয়: গলগণ্ড।
- আয়োডিনের অভাব দূরীকরণে বর্তমান কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে: খাবার লবণের সাথে আয়োডিন মেশানো হয়।
- কোন মৌল দাঁতের ক্ষয়রোধ করে: ফ্লোরাইড।
- কোন খাবারে সবচেয়ে বেশি পটাসিয়াম পাওয়া যায়: ডাব।
- কলায় কোন উপাদান বেশি থাকে: লৌহ, পটাসিয়াম।
- সামুদ্রিক আয়োডিন: হাইপোথাইরয়ডিজম (Hypothyroidism) : আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সহায়তা করে। আমাদের শরীর নিজে আয়োডিন তৈরি করতে পারে না। তাই আমাদের খাবারের সঙ্গে বাইরে থেকে এটা গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। তাই সামুদ্রিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার যেমন- সামুদ্রিক উদ্ভিদ (যেমন শৈবাল), সামুদ্রিক মাছ (যেমন: সামুদ্রিক ইলিশ) ইত্যাদি আয়োডিন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। আয়োডিনের অভাবে যখন শরীরে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না, তখন তাকে হাইপোথাইরয়ডিজম (Hypothyroidism) বলে। আয়োডিনের অভাবে প্রাথমিক এবং দৃশ্যমান লক্ষণ হলো গলগন্ড রোগ। মানবদেহের গলদেশে যে থাইরয়েড গ্রন্থি থাকে, তা যখন আয়োডিনের অভাবে ফুলে যায়, তখন তাকে গলগন্ড রোগ বলা হয়।
জিংক
উৎস : জিংকের অন্যতম উৎস হলো সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য খাবার যেমন কাঁকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, বাদাম, শিম, মাশরুম ইত্যাদি। শাক–সবজিতে বিদ্যমান জিংক শরীর সহজে হজম করতে পারে না। সে জন্য নিরামিষভোজীদের অতিরিক্ত জিংক সরবরাহ করা প্রয়োজন। একজন পুরুষ ও নারীর দৈনিক যথাক্রমে ১১ ও ৮ মিলিগ্রাম জিংক প্রয়োজন।
কাজ: জিঙ্ক ত্বক ভাল রাখতে যেমন সহায়তা করে তেমনি ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধার পিছনেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে । চোখের দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতেও জিঙ্কের ভূমিকা অপরিহার্য।
অভাবজনিত রোগ : জিঙ্কের অভাবে চুল পড়ে যাওয়া, চুলের আগা ভেঙে যাওয়া কিংবা চুল পাতলা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যেতে পারে। নখে দেখা যেতে পারে সাদা দাগ। জিঙ্কের অভাবে দেখা দিতে পারে ক্ষুধামান্দ্য। দেহে জিঙ্কের অভাব থাকলে ক্ষত নিরাময়ে ও বিলম্ব হয় । তাছাড়া জিংকের অভাবে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে । প্রয়োজনীয় বুদ্ধি লোপ পেতে পারে জিংকের অভাবে ।
সোডিয়াম
উৎস: সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের নামের তালিকা খুব দীর্ঘ। কারণ প্রায় সব খাবারই লবণ সমৃদ্ধ । আর লবণ একটি সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। কিছু উচ্চ সোডিয়াম জাতীয় খাবার যেমন আচার, পাপড়, লবণযুক্ত বিস্কুট, লবণযুক্ত মাখন, পনির ইত্যাদি ।
কাজ : সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার মৃত কোষ অপসারণ করতে সহায়তা করে। ত্বকের মধ্যে থাকা ধুলো বালি কণা দূর করতেও সহায়তা করে । এটি হজমেও সহায়তে করে । পরিমিত সোডিয়াম হৃদপিন্ড ভাল রাখে ।
অভাবজনিত সমস্যা : রক্তে সোডিয়ামের মাত্রার স্বাভাবিক পরিসীমা হল 135 থেকে 145 মিলি সমতুল্য প্রতি লিটার (mEq/L) । স্বাভাবিক মাত্রা থেকে সোডিয়াম কমে গেলে শরীরে পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে শরীরে ফুলে যায়। এর ফলে অনেক সমস্যা হতে পারে। শুধু তাই নয়, জীবনও বিপদে পড়তে পারে। গুরুতর সোডিয়ামের অভাবে কোমা হতে পারে। এটি মস্তিষ্ককে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে কারণ মস্তিষ্কের প্রদাহ স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং অন্যান্য মানসিক রোগের দিকে পরিচালিত করে।
পটাশিয়াম
উৎস: সবুজ শাক, বিনস, বাদাম ও দুগ্ধজাত খাবার পটাশিয়ামের ভালো উৎস। তাছাড়া কলা, বিটরুট , ডালিম , পালংশাক , মটরশুটি , মিষ্টি আলু , ডাবের পানি , টমেটো বা টমেটো সস ইত্যাদিতে পটাশিয়াম পাওয়া যায় । তবে পটাশিয়াম সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ডাবের পানিতে ।
কাজ : পটাশিয়াম শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে, রক্তচাপের ভারসাম্য বজায় রাখতে , কার্বোহাইড্রেট সঞ্চয করতে সাহায্য করে । এটি শরীরের মাংসপেশি তৈরিতে কাজে আসে। এছাড়াও শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট এবং অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য বজায় রাখতে পটাশিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ করতেও সাহায্য করে এই উপাদান।
অভাবজনিত সমস্যা : পটাশিয়ামের অভাব হলে তার প্রথম লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয় দুর্বলতা ও ক্লান্তি। দীর্ঘদিন ধরে পটাশিয়ামের মাত্রা কম থাকলে শরীরে ইনসুলিন কম উৎপাদিত হয় এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে। এতে মাংসপেশির দুর্বলতা এবং মাংসপেশিতে ঘন ঘন টান লাগার মতো সমস্যাও তৈরি হয়। পেশি ক্র্যাম্প বা খিঁচুনি হচ্ছে পেশির আকস্মিক ও অনিয়ন্ত্রিত সংকোচন। রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা কম থাকলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। পটাশিয়ামের অভাবের কারণে পেশি ব্যথা ও পেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।