বস্তুর ভর ও ওজন নিয়ে একটা ভুল তথ্য প্রচলিত আছে । প্রথমে এ বিষয়টি ক্লিয়ার করে নেই । মূলত আমরা যেটাকে ওজন বলে জানি পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় সেটা আসলে ভর । সাধারণত- আমরা বলে থাকি কোন বস্তুর ওজন ৫ কেজি , ১০ কেজি ইত্যাদি । কিন্তু এটা আসলে ঐ বস্তুর ওজন নয় এটা হচ্ছে বস্তুর ভর । ভর হচ্ছে মোট পদার্থের পরিমাণ । এর দ্বারা আমরা বস্তুটির পরিমাণ বুঝতে পারি । ওজন হচ্ছে কোন বস্তুকে পৃথিবী যে বলে আকর্ষণ করে । ওজনের আন্তর্জাতিক একক হল নিউটন । আমরা কি বস্তুর পরিমাণ নিউটন দ্বারা নির্ণয় করি ? অবশ্যই না । কাজেই আমরা যাকে ওজন বলে জানি সেটা হচ্ছে বস্তুর ভর ।বস্তুর ভর ও ওজন , ভর ও ওজনের পার্থক্য , বিভিন্ন স্থানে ওজনের তারতম্য উদাহরণসহ আমরা এই টিউটরিয়ালেই বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব ।
ভর ও ওজন
ভর : বস্তুর মধ্যে পদার্থের মোট পরিমাণই হচ্ছে এর ভর। একে m দ্বারা প্রকাশ করা হয় । অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে কোন বস্তুর ভর পরিবর্তিত হয় না । ভরের আন্তর্জাতিক একক কিলোগ্রাম বা কেজি (kg)। পৃথিবী পৃষ্ঠে কোন বস্তুর ভর ৪৯ কিলোগ্রাম হলে চন্দ্রপৃষ্ঠে/ মহাশূন্যে ঐ বস্তুটির ভর ৪৯ কিলোগ্রাম ।
ওজন : কোন বস্তুকে বা কোন বস্তুর ভরকে পৃথিবী যে বল দ্বারা তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে, তাকে বস্তুটির ওজন বলে । ওজন একটি বল। ওজনের একক হল বলের একক অর্থাৎ নিউটন । বস্তুটির ভর m এবং পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ 'g' হলে ওজন w = mg.
ওজনের মাত্রা: যখন কোনো বস্তু হাত থেকে পড়ে যায়, তখন তা দ্রুত মাটিকে স্পর্শ করে। এর কারণ হলো বস্তুর উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল তথা বস্তুর ওজনের জন্য এমনটি ঘটে। বলের মাত্রা ও ওজনের মাত্রা একই। ওজনের মাত্রা |
বস্তুর ভর ও ওজনের মধ্যে সম্পর্ক : কোন স্থানে বস্তুর ওজন = বস্তুর ভর × ঐ স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ। (W = mg)
বস্তুর ওজন কিসের উপর নির্ভরশীল: অভিকর্ষজ ত্বরণের উপর ।
কোন বস্তুর ভর ১০কিলোগ্রাম হলে বস্তুর ওজন কত?
উত্তরঃ আমরা জানি,
W = mg
= 10 × 9.8
= 98N
এখানে ,
বস্তুর ভর, m = 10 কেজি
অভিকর্ষজ ত্বরণ, g = 9.8 মিটার/
বস্তুর ওজন, W = ?
যদি কোন স্থানে gravitational acceleration দ্বিগুণ করা হয়, তবে সেখানে বস্তুর ওজন 2g গুণ বৃদ্ধি পাবে।
চাঁদে কোন বস্তুর উপর পৃথিবীতে ঐ বস্তুর ওজনের অংশ। কারণ চন্দ্রপৃষ্ঠে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণের মান ভূপৃষ্ঠে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণের মানের অংশ। সুতরাং চাঁদে ১ কেজি ভরের বস্তুর ওজন হবে কেবলমাত্র ১.৬ নিউটন (N)।
ভর ও ওজনের পার্থক্য
ভর ও ওজন এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে যা নিচে দেওয়া হলো-
ভর | ওজন |
---|---|
বস্তুতে অবস্থিত পদার্থের মোট পরিমাণকে ভর বলে । | বস্তু যে পরিমাণ বল দ্বারা পৃথিবীর দিকে আকর্ষিত হয় তাকে ওজন বলে । |
ভর স্থান ভেদে পরিবর্তন হয় না । | ওজন স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। |
বস্তুর ওজনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ 'g' কার্যকর | বস্তুর ভরের ক্ষেত্রে অভিকর্ষজ ত্বরণ 'g' কোনো প্রভাব নেই। |
ভরের আন্তর্জাতিক একক কিলোগ্রাম বা কেজি | ওজনের আন্তর্জাতিক একক নিউটন । |
ভর একটি মৌলিক রাশি। এর মাত্রা সমীকরণ [M]. | ওজন একটি লব্ধ রাশি। এর মাত্রা সমীকরণ [ ] |
ভর একটি স্কেলার রাশি। | ওজন একটি ভেক্টর রাশি। কারণ ওজন এক প্রকার বল । এর দিক পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। |
সাধারণ নিক্তি দিয়েই ভর মাপা যায়। | স্প্রিং নিক্তি, তুলাযন্ত্র ইত্যাদি দিয়ে ওজন মাপা হয়। |
বিভিন্ন স্থানে বস্তুর ওজন ভিন্ন হওয়ার কারণ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বস্তুর ওজন ভিন্ন হওয়ার কারণ আমরা পাই ওজন w = mg. কোন বস্তুর মধ্যকার পদার্থের মোট পরিমাণ স্থানভেদে স্থির থাকায় এর ওজন অভিকর্ষজ ত্বরণ 'g'-এর মানের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ 'g' এর মান কম বেশি হলে বস্তুর ওজন কম বেশি হয়।
(i) মেরু অঞ্চলে g-এর মান বেশি এবং বিষুব অঞ্চলে g এর মান কম। কাজেই পৃথিবীর পৃষ্ঠে, কোন বস্তুর মেরু অঞ্চলে ওজন বেশি এবং বিষুব অঞ্চলে ওজন কম, বিষুব অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে বস্তুর ওজন ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
(ii) পৃথিবীর কেন্দ্রে বস্তুর ওজন শূন্য, কারণ এখানে g = 0
সুতরাং w = mg
বা, w = 0
(iii) পাহাড়ের চূড়ায় বস্তুর ওজন ভূপৃষ্ঠের তুলনায় কম। ভূপৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সর্বোচ্চ।
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বস্তুর ক্ষেত্রে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R বেশি হওয়ায় g-এর মান কম। অর্থাৎ w = mg অনুসারে বস্তুর ওজন কম। সুতরাং যতই উপরে যাওয়া যাবে বস্তুর ওজন তত কমতে থাকবে। চাঁদে বস্তুর ওজন তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় কম (ছয় ভাগের এক ভাগ)।
(iv) খনির ভেতরে বস্তুর ওজন ভূপৃষ্ঠের তুলনায় কম। খনির ভেতরে কোন বস্তুর ক্ষেত্রে, পৃথিবীর বর্তমান ভর M এর তুলনায় কার্যকর ভর M' কম এবং পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R অপেক্ষা কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্ব কম। এ কারণে দেখা যায় যে, খনির ভেতরে ভূপৃষ্ঠের তুলনায় g-এর মান কম অর্থাৎ বস্তুর ওজন কম।
পাহাড় বা পর্বতশীর্ষে বস্তুর ওজন কম হয় কেন: ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মানও তত কমতে থাকে। এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় বস্তুর ওজনও তত কমতে থাকে ।
খনিতে কোন বস্তুর ওজন কম হয় কেন : ভূ-পৃষ্ঠে থেকে যত নিচে যাওয়া যায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ততই কমতে থাকে । এর ফলে পৃথিবীর যত অভ্যন্তরে যাওয়া যায় বস্তুর ওজন তত কমতে থাকে ।
এক ব্যক্তি দালানের দশতলায় একটি লিফটে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কোনো স্প্রিং নিক্তি থেকে ঝুলানো একটি বস্তু 10 নিউটন ওজন নির্দেশ করছে। হঠাৎ লিফটের তার ছিঁড়ে লিফটটি মুক্তভাবে নিচে পড়তে থাকলে স্প্রিং নিক্তিতে বস্তুটির ওজন কত নির্দেশ করবে: 0 নিউটন । কারণ লিফটের সাপেক্ষে বস্তুর ত্বরণ হবে (g-g)= 0 ।
এক ব্যক্তি লিফটে g এর চেয়ে বেশি ত্বরণ সহকারে নিচে নামলে কি ঘটবে: ব্যক্তিটি শূন্যে ভাসতে থাকবে এবং মাথা লিফটের ছাদে ঠেকে যাবে।
মহাশূন্যচারী মহাশূন্যযানে পৃথিবী প্রদক্ষিণরত থাকার সময় নিজেকে ওজনহীন মনে করেন কেন: মহাশূন্যচারীরা মহাশূন্যযানে করে পৃথিবীকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বৃত্তকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে থাকেন। এই বৃত্তাকার গতির জন্য মহাশূন্যযানের পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ঐ উচ্চতায় g এর মানের সমান মানের একটি ত্বরণ হয় । এই অবস্থায় মহাশূন্যযানের দেয়ালের সাপেক্ষে মহাশূন্যচারীর ত্বরণ (g-g)=0 হয় এবং মহাশূন্যচারী মহাশূন্যযানের দেয়াল বা মেঝেতে কোন বল প্রয়োগ করে না। ফলে তিনি তাঁর ওজনের বিপরীত কোন প্রতিক্রিয়া বলও অনুভব করেন না। তাই তিনি ওজনহীনতা অনুভব করেন।
লিফটে নামার সময় নিজেকে ওজনহীন মনে হয় কেন: লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করি। তখন লিফটও আমাদের উপর বিপরীতমুখী যে প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে তা আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি হয় এবং নিজেদেরকে ভারী অনুভব করি । কিন্তু এরপর লিফট যখন সমবেগে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার কোনো ত্বরণ থাকে না, ফলে আমরা আর ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত বল অনুভব করি না, কেবল ওজনই অনুভব করি। অপরপক্ষে লিফট যখন নিচে নামতে শুরু করে তখন স্থির অবস্থান থেকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয় এবং লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ g এর চেয়ে কম হয়। এ কম ত্বরণ নিয়ে আমরা লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে কম বল প্রয়োগ করি। ফলে, আমরা হালকা বোধ করি অর্থাৎ আমাদের ওজন কম মনে হয়। লিফট যদি মুক্তভাবে নিচে পড়ে অর্থাৎ, লিফটেরও যদি g ত্বরণ হয়, তবে লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হবে (g - g) অর্থাৎ শূন্য। ফলে আমরা লিফটের উপর কোনো বল প্রয়োগ করব না। তখন লিফটও আমাদের ওজনের বিপরীতে আমাদের উপর কোনো প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করবে না এবং আমরা নিজেদেরকে ওজনহীন মনে করব । কোনো লিফটের কেবল বা দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে লিফটটি যদি অভিকর্ষের প্রভাবে নিচে পড়ে তখন এ অবস্থার উদ্ভব হবে। এ অবস্থায় যদি লিফটের ছাদ থেকে ঝুলন্ত বা লিফটে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তির হাতে ধরা স্প্রিং নিক্তি থেকে একটি বস্তু ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে স্প্রিং নিক্তির কাঁটা শূন্য দাগে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, বস্তুটির ওজন শূন্য ।
উপরের দিকে ঢিল ছুঁড়লে তার বেগ আস্তে আস্তে কমে যায় কেন : কোন বস্তু উপরের দিকে উঠতে থাকলে অভিকর্ষীয় বলের বিপরীতে কাজ সম্পন্ন হয়। ফলে 'g' এর মান ঋণাত্মক হয় এবং এক পর্যায়ে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে থাকে। কাজেই অভিকর্ষীয় বলের বিপরীতে কাজ হয় বলে ঢিল ছুঁড়লে বেগ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।
কোন বস্তুকে পাহাড়ের চূড়ায় বা খনির ভেতরে নিয়ে গেলে এর ওজনের কিরূপ তারতম্য ঘটবে? পাহাড়ের চূড়ায় বস্তুর ওজন ভূ-পৃষ্ঠের তুলনায় কম হবে। কারণ, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বস্তুর ক্ষেত্রে ভূ-পৃষ্ঠের তুলনায় পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্ব বেশি বলে 'g'-এর মান কম হবে। আর 'g' এর মান কম হলে বস্তুর ওজন কম হয় । খনির ভেতরে বস্তুর ওজন ভূ-পৃষ্ঠের তুলনায় কম । কারণ, খনির ভেতরে স্থাপিত বস্তুর ক্ষেত্রে পৃথিবীর বর্তমান ভর M এর তুলনায় কার্যকর ভর M কম এবং পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R-এর তুলনায় কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্ব কম। এ কারণে খনির ভেতরে ভূপৃষ্ঠের তুলনায় বস্তুর ওজন কম ।
পড়ন্ত বস্তুর সূত্র
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পড়ন্ত বস্তুর সূত্র প্রদান করেন। সূত্রগুলো হল-
প্রথম সূত্র : স্থির অবস্থান থেকে এবং একই উচ্চতা থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত সকল বস্তু সমান সময়ে সমান দূরত্ব অতিক্রম করবে।
দ্বিতীয় সূত্র : স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপ্ত বেগ ঐ সময়ের সমানুপাতিক।
তৃতীয় সূত্র: স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তু নির্দিষ্ট সময়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা ঐ সময়ের বর্গের সমানুপাতিক ।
কেপলারের সূত্র
১৬১৮ সালে ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ জন কেপলার বলেন, গ্রহগুলো কোন এক বলের প্রভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এ সম্পর্কে তিনি তিনটি সূত্র প্রদান করেন :
১. উপবৃত্ত সূত্র : প্রতিটি গ্রহ সূর্যকে উপবৃত্তের নাভিতে বা ফোকাসে রেখে একটি উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে।
২. ক্ষেত্রফল সূত্র : গ্রহ ও সূর্যের সংযোগকারী ব্যাসার্ধরেখা সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে
৩. সময়ের সূত্র : প্রতিটি গ্রহের পর্যায়কালের বর্গ সূর্য হতে এর গড় দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক ।