পরমাণু মূলত তিনটি মৌলিক কণিকার সমন্বয়ে তৈরি। এরা হল - ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এদের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন গঠন করে পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রন বা ইলেকট্রনসমূহ নিউক্লিয়াসের চারদিকে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘূর্ণনরত। প্রোটন ধনাত্মক চার্জ, ইলেকট্রন ঋণাত্মক চার্জ এবং নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ । নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটনের সমসংখ্যক ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে থাকে। ফলে পরমাণু চার্জনিরপেক্ষ। নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে ফেললে এর ভর সামান্য হ্রাস পায়। এই হারানো ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত এ শক্তিই নিউক্লিয় শক্তি বা পারমাণবিক শক্তি ।
পারমাণবিক শক্তি / নিউক্লিয় শক্তি
নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে বা বিভাজন করে অথবা দুটি হাল্কা নিউক্লিয়াসকে একত্রিত করে যে শক্তি পাওয়া যায়, এই শক্তিকে বলা হয় নিউক্লিয় শক্তি(Nuclear energy)। একে পারমাণবিক শক্তি (Atomic energy) নামেও অভিহিত করা হয়। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দেখান যে, পদার্থ এবং শক্তি প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন। কোন বস্তুর ভর m এবং আলোর বেগ C হলে, বস্তুটিকে সম্পূর্ণরূপে শক্তিতে রূপান্তর করতে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ E = m । এটি আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস (এস এন বোস) আইনস্টাইনের সাথে যৌথভাবে প্রকাশ করেন বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব। পারমাণবিক বিস্ফোরণে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণের সাহায্যে পরিমাপ করা যায়। পারমাণবিক বিস্ফোরণে সংঘটিত নিউক্লিয় চেইন বিক্রিয়ার সাহায্যে নিউক্লিয় শক্তি উৎপন্ন করা হয়। পরমাণু হতে দুটি পদ্ধতিতে এ নিউক্লিয় শক্তি উৎপন্ন করা যায়- ক) নিউক্লিয় ফিউশন খ) নিউক্লিয় ফিশন ।
নিউক্লিয় ফিউশন
যে প্রক্রিয়ায় একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং অত্যধিক শক্তি নির্গত হয় তাকে নিউক্লীয় ফিউশন বলে। এ প্রক্রিয়ায় ১০ সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে দুটি ডিউটেরনের সংযোগের ফলে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয়। নিউক্লীয় ফিউশনের ক্ষেত্রে উৎপন্ন নিউক্লিয়াসগুলোর মোট ভর প্রারম্ভিক নিউক্লিয়াসগুলোর মোট ভর অপেক্ষা কম হয় । অর্থাৎ ফিউশনের ফলে ভরের হ্রাস ঘটে। হারানো ভর শক্তিতে পরিণত হয়। নিউক্লিয়াসগুলো ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট হওয়ায় দুটি নিউক্লিয়াসের ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে হলে নিউক্লিয়াস দুটিকে উচ্চ গতির অধিকারী হতে হয়, যাতে করে এরা বিকর্ষণ বলের প্রভাব অতিক্রম করতে পারে। নিউক্লিয় ফিউশন নীতির উপর ভিত্তি করে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা হয় । সূর্যে শক্তি উৎপন্ন হয় পরমাণুর ফিউশন পদ্ধতিতে।
ফিউশনকে তাপ নিউক্লিয় বলা হয়। কারণ, অত্যধিক উচ্চ তাপমাত্রায় ( °C)সংঘটিত হয় বলে।
উদযান বোমা (Hydrogen Bomb) যে নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে: ফিউশন ।
উদযান বোমা তৈরীতে যা ব্যবহৃত হয়: হাইড্রোজেনের আইসোটোপ- ডিউটেরিয়াম, ট্রাইটিয়াম।
সূর্যে কিভাবে শক্তি উৎপন্ন হয়: সূর্যে হাল্কা পরমাণুর ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানীগন ধারণা করেন যে, ৪টি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস এক জটিল নিউক্লিয় ফিউশন মাধ্যমে ১টি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়।
নিউক্লিয় ফিশন
যে প্রক্রিয়ায় ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয়ে প্রায় সমান ভরের দুটি নিউক্লিয়াস উৎপন্ন করে এবং একাধিক নিউট্রন ও বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় তাকে ফিশন বলে। নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে যদি কোন ভারি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে প্রায় সমস্তরবিশিষ্ট দুটি অংশে বিভক্ত করা যায় এবং প্রচণ্ড পারমাণবিক শক্তির উদ্ভব হয়, তাহলে নিউক্লিয়াসের এ বিভাজনই নিউক্লীয় ফিশন । ফিশন এর মূল কথা হল নিউক্লিয়ার বিভাজন। সাধারণত যে সব পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা ৯২ বা তার অধিক তারা ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।
ফিশন আবিষ্কার করেন: জার্মান বিজ্ঞানী অটো হ্যান; ১৯৩৯ সালে।
প্রতিটি ফিশনে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়: 200 MeV।
চেইন বিক্রিয়া (Chain reaction) বা শৃঙ্খলা বিক্রিয়া: যে বিক্রিয়া একবার শুরু হলে তা আপনা আপনি চলতে থাকে, তাকে চালাবার জন্য অন্য কোন অতিরিক্ত উৎস বা শক্তির প্রয়োজন হয় না, তাকে চেইন বিক্রিয়া বলে ।
ইউরোনিয়াম-২৩৫ পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে ফিশনের ফলে দুইটি নিউক্লিয়াস ও তিনটি নিউট্রন উৎপন্ন হবে। এই তিনটি নিউট্রন আরও তিনটি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে ফিশন ঘটাবে; ফলে পাওয়া যাবে নয়টি নিউট্রন । এই নয়টি নিউট্রন আরও নয়টি নিউক্লিয়াসে ফিশন ঘটিয়ে সৃষ্টি করবে সাতাশটি নিউট্রন। ইউরোনিয়াম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিক্রিয়া চলতে থাকবে।
PCR-এর পরিপূর্ণ অর্থ: পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন।
নিউক্লিয় বিক্রিয়ক বা নিউক্লিয় চুল্লি: নিউক্লিয় চেইন বিক্রিয়াকে যে যন্ত্রে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তার নাম নিউক্লিয় রিয়াক্টর (Nuclear Reactor) বা নিউক্লিয় বিক্রিয়ক । একে পারমাণবিক চুল্লিও বলা হয়।
নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরে গতি মন্থরক হিসাবে যা ব্যবহৃত হয়: ক্যাডমিয়াম বা বোরন দণ্ড বা গ্রাফাইট ।
ক্যাডমিয়াম বা বোরন দণ্ড কিভাবে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার গতিকে মন্থর করে দেয়: নিউট্রন শোষণ করে।
পারমাণবিক বোমা (Atom Bomb) যে নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে: ফিশন ।
পারমাণবিক বোমা তৈরীতে যে তেজস্ক্রিয় মৌল ব্যবহৃত হয়: ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম ।
পারমাণবিক বোমার আবিষ্কারক: ওপেন হেইমার। তিনি ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমার আবিস্কার করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন।
নিউক্লিয় শক্তি ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা
নিউক্লিয় শক্তি ব্যবহারের সুবিধা | নিউক্লিয় শক্তি ব্যবহারের অসুবিধা |
---|---|
এই শক্তির সাহায্যে কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। | পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প তৈরিতে সময় বেশি লাগে । |
স্বল্প জ্বালানি ব্যয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। | জ্বালানিকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা বেশ ব্যয় সাপেক্ষ । |
অন্যান্য শক্তি উৎস ফুরিয়ে গেলেও পারমাণবিক শক্তির উৎস নিঃশেষিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। | অত্যন্ত উচ্চমানের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন । |
একবার শক্তি উৎপাদন শুরু হলে স্বল্প ব্যয়ে দীর্ঘদিন শক্তি পাওয়া যায়। | যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে দ্রুত মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয়। |