বাংলা কাব্যসাহিত্যের বীরযুগের অন্যতম প্রধান কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরবর্তীকালে সর্বাধিক খ্যাতিমান কবি ছিলেন তিনি । তিনি মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে তৎকালীন ইংরেজ শাসিত ভারতীয়দের, বিশেষত বাঙালি শিক্ষিত মহলে স্বদেশপ্রেমের উত্তেজনা সৃষ্টি করেন । তিনি মূলত মহাকাব্যের কবি ছিলেন ।
জন্ম ও বংশপরিচয়
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৭ এপ্রিল, ১৮৩৮ সালে হুগলি জেলার গুলিটা রাজবল্লভহাট গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন । তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলির উত্তরপাড়া গ্রামে। গুলিটা রাজবল্লভহাট গ্রামের কুলীন ঘরে জন্ম হয় তার। কুলীন অর্থ হলো উত্তম পরিবার বা সম্ভ্রান্ত বংশজাত। সম্মানলাভার্থে প্রজারা সৎপথে চলবে, এই উদ্দেশ্যে বাংলার সেন বংশের রাজা বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বজ্যৈষ্ঠ। তার অনুজ ঈশানচন্দ্র ও ছিলেন প্রথিতযশা কবি এবং আইনজীবী । পিতা কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অতিশয় দরিদ্র। কিন্তু কেীলিন্যের মানদন্ডে তিনি বিবাহ করেছিলেন গুলিটা, রাজবল্লভহাট গ্রাম নিবাসী কলকাতা আদালতের মোক্তার রাজচন্দ্র চক্রবর্তীর একমাত্র সন্তান আনন্দময়ীকে । কৈলাসচন্দ্র বিশেষ কোন কর্ম করতেন না বিধায় শ্বশুরবাড়িতেই বসবাস করতেন ।
শিক্ষাজীবন
নয়বছর বয়স পর্যন্ত হেমচন্দ্র গ্রামের পাঠশালাতেই পড়াশোনা করেছিলেন । তারপর তাঁর মাতামহ রাজচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে খিদিরপুরের বাসভবন নিয়ে আসেন এবং খিদিরপুরের বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দেন পড়াশোনার জন্য । ছোটবেলা থেকেই হেমচন্দ্র ধীর , স্থির এবং শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন । কিন্তু হেমচন্দ্র খিদিরপুরের বাংলা স্কুলে থাকাকালীন অকস্মাৎ তাঁর মাতামহ রাজচন্দ্র চক্রবর্তী মৃত্যুমুখে পতিত হন। এর ফলে আর্থিক সংকটে পড়ে তাঁর পরিবার । ফলে হেমচন্দ্রের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সহায়তায় আবার ও পড়াশোনা শুরু করতে পেরেছিলেন । তিনি ১৮৫৩ সালে হেমচন্দ্রকে কলকাতার হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। হেমচন্দ্র খুবই মেধাবী ছিলেন তাই কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে ১৮৫৫ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন । একই বছর কলকাতার ভবানীপুর নিবাসী কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কামিনী দেবীর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সালে সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে দুই বছরের জন্য মাসিক পচিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি । কিন্তু চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণিতে পাঠকালে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আবার ও বিপাকে পড়েন হেমচন্দ্র । তাই লেখাপড়া ত্যাগ করে চাকরিতে প্রবেশ করেন তিনি ।
কর্মজীবন
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক শেষ করার পূর্বেই ১৮৫৯ সালে হেমচন্দ্র মিলিটারি অডিট অফিসে ৩৫ টাকা বেতনে কেরানী পদে চাকরি গ্রহণ করেন । তবে এই চাকরি তিনি বেশিদিন করেন নি । ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । ১৮৫৯ সালেই চাকরির পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়বারের স্নাতক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি । এরপর হেমচন্দ্র মিলিটারি অডিট অফিসের চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং যোগ দেন কলকাতা ট্রেনিং স্কুলে হেডমাস্টার পদে ৫০ টাকা মাসিক বেতনে । খিদিরপুর থেকে প্রতিদিন স্কুলে আসত অসুবিধা হত বিধায় তখন কলকাতার একটি মেসে থাকতে হয়েছিল তাকে । এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিভাগ শুরু হওয়ায় পরবর্তী বছর ১৮৬০ সালে তিনি সেখান থেকে বি.এল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন । কিন্তু অকৃতকার্য হওয়ার ফলে তিনি শুধু এল.এল ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হন । আপাতত এই এল.এল ডিগ্রিকে কেন্দ্র করেই তিনি রমাপ্রসাদের পরামর্শে মুন্সেফী পদের জন্য আবেদন করেন এবং তা মঞ্জুর হয় । যার ফলে ১০০ টাকা মাসিক বেতনে প্রথমে শ্রীরামপুরে এবং পরে হাওড়ায় মুন্সেফ পদে কাজ করার সুযোগ পান । এর কিছুকাল পরে ১৮৬১ সালের ১৯ মার্চ মুন্সেফের চাকরি ছেড়ে কলকাতার হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন । ১৮৬৬ সালে তিনি আবার ও বি.এল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতকার্য হন । এই আইন ব্যবসায় তিনি এতটাই সুনাম অর্জন করেন যে ১৮৯০ সালের এপ্রিল মাসে সরকারি উকিল নিযুক্ত হন ।
সাহিত্যকর্ম
আইন ব্যবসায় নিযুক্ত থাকলে ও হেমচন্দ্রের প্রধান পরিচয় তিনি একজন দেশপ্রেমিক যশস্বী কবি। আসলে স্বভাবে ছিলেন তিনি একজন পরিপূর্ণ কবি । যে বছর কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন সে বছরই অর্থাৎ ১৮৬১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চিন্তাতরঙ্গিনী প্রকাশিত হয় । 'চিন্তাতরঙ্গিনী' প্রতিবেশী এক বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনা অবলম্বনে রচিত । তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য বৃত্রসংহার (১ম খণ্ড ১৮৭৫, ২য় খণ্ড ১৮৭৭)। এ মহাকাব্যের মাধ্যমে তিনি স্বদেশ প্রেমের উত্তেজনা সঞ্চার করেন । এডুকেশন গেজেট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় । সেই পত্রিকায় ১৮৭২ সালের জুলাই সংখ্যায় তার 'ভারত সঙ্গীত' কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন এবং সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কেও সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয় যদি ও ভূদেব বাবু সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিয়ে সরকারকে শান্ত করতে পেরেছিলেন । এই কবিতায় স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষভাবে ভারতবাসীকে ব্রিটিশ অত্যাচারের শৃঙ্খল ছিন্ন করে মুক্ত হবার আহ্বান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম জাতীয় কবি যিনি সমগ্র স্বাধীন ভারতের এক সংহতিপূর্ণ চিত্র দেখেছিলেন। 'ভারতবিলাপ', 'কালচক্র','রিপন উৎসব','ভারতের নিদ্রাভঙ্গ', 'গঙ্গা', 'জন্মভূমি' ইত্যাদি আরোকিছু রচনার মাধ্যমে স্বদেশ প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
মহাকাব্য
বৃত্রসংহার : হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত মহাকাব্য বৃত্রসংহার । যার প্রথম খন্ড ১৮৭৫ সালে এবং দ্বিতীয় খন্ড ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় । এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা । দুই খন্ডে রচিত মহাকাব্য জাতীয় রচনা “বৃত্রসংহার” তাঁকে এনে দিয়েছে সমধিক খ্যাতি। হিন্দু জাতীয়তাবোধ প্রকাশের লক্ষ্যে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে তিনি এ মহাকাব্য রচনা করেন। বৃত্র নামক অসুর কর্তৃক স্বর্গবিজয় এবং দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক স্বর্গের অধিকার পুনঃস্থাপন ও বৃত্রাসুরের নিধন এ মহাকাব্যের মূল বিষয়। পৌরাণিক কাহিনির নূতন ব্যাখ্যা ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনজিজ্ঞাসা, অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার ইত্যাদি ব্যাপারে মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র অনুসারী । ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই কাব্য অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ এ কাব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ।
কাব্য গ্রন্থ
- চিন্তাতরঙ্গিণী (১৮৬১) : এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ । 'চিন্তাতরঙ্গিনী' প্রতিবেশী এক বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনা অবলম্বনে রচিত ।
- বীরবাহু (১৮৬৪) : এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ । এ কাব্যে দেশপ্রেমের অঙ্কুর ফুটে উঠতে লক্ষ করা যায় এবং ছন্দ ও অনেকটা স্বচ্ছন্দ গতি লাভ করে ।
- নলিনীবসন্ত (১৮৬৪): এটি শেক্সপিয়রের The Tempest অবলম্বনে রচিত ।
- আশাকানন (১৮৭৬) : হেমচন্দ্রের ‘আশাকানন' রূপক কাব্য, দশটি কল্পনায় কাব্যটি বিন্যস্ত ।
- ছায়াময়ী (১৮৮০) : ‘ছায়াময়ী' কাব্যটি দান্তের ডিভাইন কমেডিয়ার অনুসরণে লেখা ।
- দশমহাবিদ্যা (১৮৮২) : কবি ‘তন্ত্রসারে’ গ্রন্থে উদ্ধৃত ধ্যানমগ্ন থেকে কালী, তারা, ষোঢ়শী, ছিন্নমস্তা প্রমুখ দেবীর রূপমূর্তি গ্রহণ করলেও তিনি দেবীর দশটি রূপের মধ্যে মানব সভ্যতার দশটি রূপের মধ্যে মানব সভ্যতার দশটি বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন ।
- চিত্তবিকাশ (১৮৯৮) : স্বদেশ প্রেমের বার্তা ।
- কবিতাবলী ( ১৮৭০) : এটি তাঁর খণ্ড কবিতার সংকলন ।
খন্ড কবিতা
- জীবন সঙ্গীত (এটি হেনরি ওয়েডসওয়ার্থ লংফেলোর A Psalm of Life কবিতাটির ভাবানুবাদ )
- ভারত সঙ্গীত
- ভারতবিলাপ
- গঙ্গার উৎপত্তি
- পদ্মের মৃণাল
- ভারত-কাহিনী
- অশোকতরু
- কুলীন কন্যাগণের আক্ষেপ
- ইত্যাদি খন্ড কবিতা তাঁর অভূতপূর্ব সৃষ্টি।
মৃত্যু
জীবন সায়াহ্নে তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং চরম দারিদ্র্যের মুখে পতিত হয়ে ২৪ মে, ১৯০৩ সালে কলকাতার খিদিরপুরে মারা যান ।