শূন্যপুরাণের সৃষ্টিতত্ত্ব
প্রথমে কিছুই ছিল না, কেবল অনাদি প্রভু ছিলেন ‘শূন্যের ভরমণ প্রভুর শূন্যে করি ভর’। এবং ‘কাহারে জন্মাব পরভু ভাবে মায়াধর'। তারপর ‘অনিল’ দুইজন সৃষ্টি করে ‘বিস্ব’ বা বুদবুদের উপর আসন করলেন, তারপর ‘আপনি সৃজিলেন প্রভু আপনার কায়া'। প্রভুর দেহ থেকে জন্মালেন ‘নিরঞ্জন ধর্ম’। তাঁর ‘হাই” থেকে জন্মালেন উল্লুক পক্ষী। উল্লুকের পৃষ্ঠে বসলেন ধর্ম। উল্লুক ক্লান্ত হলে ধর্ম তাকে মুখামৃত দিলেন, অমৃতের কিছু শূন্যে পড়ল, তা থেকে হলো জল। জলে ভাসল উল্লুক, উল্লুকের পাখা খসে পড়ল জলে, তা থেকে হলো পরমহংস। ধর্ম হাঁসের পিঠে চাপলেন। বহু বহু যুগ পরে ক্লান্ত হাঁস উড়ে পালালো।
জল হলো ঊর্মিমুখর। শান্ত করার জন্য ধর্ম জলে হাত দিলেন, তাতেই কূর্মের উদ্ভব। কূর্মের পিঠে ভর করলেন ধর্ম। উল্লুক ধর্মকে ছায়া দিয়ে পাশে থাকল। একসময়ে ভার অসহ্য হলে কূর্ম পালালো। এবার উল্লুকের পরামর্শে (জলের উপর করু সৃষ্টির সাজন) ধর্ম মন দিলেন কার্যে। প্রথমেই নিজের কণক পৈতা ছিঁড়ে ফেললেন, তাতেই জন্মাল সহস্রফণা বাসুকি। ক্ষুধার্ত বাসুকি আহার খোঁজে, ভীত ধর্ম কানের কুণ্ডল জলে ছুঁড়লেন- তাতে জন্মাল ভেক। তৃপ্ত বাসুকি ধর্মের মাথায় ফণার ছত্র ধরে থাকল। এবার ধর্ম নিজের হাতে তাঁর গলার ময়লাগুলো রাখলেন বাসুকির মাথায়, তাতে তৈরি হলো নবদ্বীপ পৃথিবী।
ধর্ম ও উল্লুক পৃথিবী ঘুরে দেখতে লাগলেন, তাতে ঘর্মাক্ত হলেন পরিশ্রান্ত ধর্ম। তাঁর ঘর্মাক্ত থেকে আদ্যাশক্তিরূপিণী নারীর উদ্ভব হলো। ধর্ম এ সময়ে বল্লুকা নদীও সৃষ্টি করলেন। নদী তীরে ধর্ম প্রজা সৃষ্টির মানসে চৌদ্দযুগ ধরে রইলেন ধ্যানে। এদিকে আদ্যাশক্তি হলেন যৌবনবর্তী। তাঁর যৌবনচেতনা থেকে জন্মাল কাম। উল্লুক কামদেবকে লুকিয়ে রাখল। এতেই বল্লুকায় কালকূট বিষের উদ্ভব। ধ্যানশেষে ধর্ম আদ্যাশক্তির কাছে বিষ ও মধু রেখে বের হলেন তাঁর বরের সন্ধানে। এদিকে যৌবন যন্ত্রণা অসহ্য হওয়ায় আদ্যা বিষ পান করলেন, তাতে মৃত্যুর বদলে তাঁর গর্ভসঞ্চার হলো।
যথাকালে তিনি প্রসব করলেন তিন সন্তান ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবকে। তিনজনই তখন অন্ধ। জন্মমাত্র তিনজনই তপস্যায় বসলেন বল্লুকাতীরে। ধর্ম তাঁদের পরীক্ষা করবার জন্য গলিত শবরূপে ভেসে চললেন তাঁদের সম্মুখ দিয়ে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু তিন অঞ্জলি জল দিয়ে দুর্গন্ধ শবকে দূরে ভাসালেন। শিব কিন্তু বুঝলেন কোথাও যখন মরবার মতো কেউ নেই, তখন এ নিশ্চিত শ্রীধর্মনিরঞ্জনের ছলনা। তাই শিব দুর্গন্ধ শব তুলে নিয়ে নৃত্য করতে লাগলেন । ধর্মের ইচ্ছাক্রমে শিবের মুখামৃতে তিনজনেরই ঘুচল অন্ধত্ব। এ হচ্ছে আসলে জ্ঞানচক্ষুলাভ। তারপর ব্রহ্মাকে সৃষ্টির, বিষ্ণুকে পালনের এবং শিবকে সংহারের ভার দেয়া হলো। আদ্যাশক্তির প্রার্থনাক্রমে শ্রীধর্মনিরঞ্জন তাঁকে বর দিলেন কয়েকবার ইচ্ছামৃত্যু হয়ে তিনি শিবপত্মী হলেন।