নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ ঢং বা রীতি। নাটক বাংলা সাহিত্যতত্ত্বের একটি পারিভাষিক শব্দ । যেটি ইংরেজি Drama/Play শব্দের পরিভাষা হিসেবে বাংলায় গৃহীত হয়েছে। সাধারণত একটি লিখিত ডকুমেন্ট অনুসরণ করে অভিনয় করে নাটক পরিবেশন করা হয়ে থাকে। যেহেতু নাটক অভিনয়ের জন্যই লেখা হয় সেহেতু তাকে অভিনয় করার যোগ্য হতে হয়। লেখার পূর্বেই অভিনয়ের স্থান,কাল, পাত্র ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।নতুবা একটি সার্থক নাটক লেখা সম্ভব নয়। নাটক প্রদর্শনের মূল হাতিয়ার সংলাপ। কাহিনি, চরিত্র, ঘটনাসমাবেশ ও সংলাপ হলো নাটকের মূল অঙ্গ । সংলাপবিহীন অভিনয়ও নাটকে প্রদর্শিত হয়। বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বা শুরুটা জানতে হলে আমাদেরকে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বেকার সময়ে ফিরে যেতে হবে। কারণ তখন থেকেই বাংলা নাটকের উৎপত্তি। শুরুতে আমরা নাটক কাকে বলে জেনে আসি।
নাটক কাকে বলে
নাটক সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য এবং তা সব প্রকার কাব্য ও সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। নাটক দৃশ্য ও শ্রব্যকাব্যের সমন্বয়ে নাট্যমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে। নাট্যমঞ্চের সাহায্য ছাড়া নাটকীয় বিষয় পরিস্ফুটিত হয় না। মূলত রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে মানুষের সুখ-দুঃখকে স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে নাটক বলে। নাটক সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। নাটকে রস উপলদ্ধির বিষয়টি জড়িত বলে ,এর অপর নাম ‘দৃশ্যকাব্য’। মূলত দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্যের সমন্বয়ে নাটক মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের কাছে মূর্ত্ত করে তোলে। অন্য কথায় কোনো দ্বন্দ্বমূলক আখ্যান যদি চরিত্রসমূহের সংলাপের মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠে তাহলে তাকে নাটক বলে । নাটকের উপাদান চারটি যথা ১.মূল ভাবনা বা প্রেমিজ ২.কাহিনি বা প্লট ৩.চরিত্র ৪. সংলাপ। গদ্যরীতির উৎকর্ষের পরেই নাটকের যাত্রা। বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এর প্রথম পর্যায়ে আমরা নাট্যমঞ্চের উৎপত্তি সম্পর্কে জানব।
বাংলা নাট্যমঞ্চের উৎপত্তি
১৭৫৩ সালে ইংরেজরা কলকাতার লালবাজারে “প্লে হাউস” নামে প্রথম রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করেন। বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৭৯৫ সালে। প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী হেরাসিম লেবেদেফ। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) তিনি ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ নামক একটি নাট্যমঞ্চ স্থাপন করেন। এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল, যেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই অভিনীত হতো। হেরাসিম লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন, যেমন: হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায়ও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি (১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ (১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার (১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০৫), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ( টাঙ্গাইল, ১৯১১) ইত্যাদি। এ সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষ, এলেংগা, শিবপুর, আলোয়া ও করটিয়ার জমিদাররা বেশ কয়েকটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়।
বাংলা নাটকের বিকাশ
১৭৯৫ সালে হেরাসিম লেবেডেফ প্রথম The Disguise ও Love is the best Doctor নামে দুটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে এদেশীয় পাত্র-পাত্রীর দ্বারা অভিনয় করান। ’The Disguise ও Love is the best Doctor’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম নাটক। তবে এগুলো অনুবাদ নাটক। তখনো বাংলা ভাষায় কোন নাটক লেখা হয় নি। বাংলা নাটক প্রথম মঞ্চে অভিনীত হয় ১৮৩১ সালে।
প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক তারাচরণ শিকদার কর্তৃক ১৮৫২ সালে রচিত ‘ভদ্রার্জুন' । এ নাটকের মূল বিষয় অর্জুন কর্তৃক সুভদ্রা হরণের কাহিনি। মহাভারত থেকে কাহিনি সংগ্রহ করা হলেও বাঙালি সমাজের বাস্তব পরিবেশ এতে অঙ্কিত হয়েছে। এটি বাঙালি কর্তৃক এবং বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কমেডি নাটক ।
১৮৫২ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত রচিত ‘কীর্তিবিলাস' বাংলা ভাষার প্রথম বিয়োগান্তক বা ট্র্যাজেডি নাটক। সপত্নীপুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচারের কাহিনি অবলম্বনে এটি রচিত। বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যুর মাধ্যমে ট্রাজেডির রূপায়ণ এ নাটকের বৈশিষ্ট্য।
১৮৫৯ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘শর্মিষ্ঠা’ বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ও আধুনিক নাটক। এটি রচিত হয়েছে পুরাণের কাহিনি অবলম্বনে । এজন্য তাঁকে বাংলা নাটকের পথিকৃত বলা হয় ।মূলত মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা নাটক প্রতিষ্ঠিত রুপ পায়।
১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘পদ্মাবতী' বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক কমেডি নাটক। এ নাটকের ২য় অঙ্কের ২য় গর্ভাঙ্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করেন। এটি গ্রিক পুরাণের Apple of Discord অবলম্বনে রচিত।
১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘কৃষ্ণকুমারী' বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক বিয়োগান্তক বা ট্রাজেডি নাটক। উইলিয়াম টডের ‘রাজস্থান' নামক গ্রন্থ থেকে মধুসূদন এ নাটকের কাহিনি সংগ্রহ করেন। চরিত্র: কৃষ্ণকুমারী, মদনিকা, ভীমসিং, বিলাসবতী।
বাংলা ভাষার মুসলমান রচিত প্রথম নাটক ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বসন্ত কুমারী'। বৃদ্ধ রাজা বীরেন্দ্র সিংহের যুবতী স্ত্রী রেবতী সপত্নী পুত্র নরেন্দ্র সিংহকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পরিণামে সমগ্র রাজ পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়, এটিই এ নাটকের মূল বিষয়।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম নাটক ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ'। এতে মেহেরপুরের কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঢাকায়। এ নাটকের অভিনয় দেখতে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মঞ্চের অভিনেতাদের লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন A Native ছদ্মনামে ইংরেজিতে The Indigo Planting Mirror নামে অনুবাদ করেন। চরিত্র: নবীন মাধব, তোরাপ।
আপনার জন্য আরো : বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং শ্রেণীবিভাগ
৪৭-পূর্ববর্তী বাংলা নাটক
উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সাহিত্যিকগণ কর্তৃক যে সব নাটক রচিত হয়েছে তার প্রেক্ষাপট ছিল তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা। ইতিহাসের বিষয়বস্তু তাদের শিল্পীমানসে তেমন প্রভাব বিস্তার করে নি। তাই ঐতিহাসিক নাটকের তুলনায় নকশা জাতীয় ও প্রহসনধর্মী সামাজিক নাটক সৃষ্টি হয়েছে বেশি। ৪৭- পূর্বকালে শাহাদাৎ হোসেন, আবুল ফজল এবং ইব্রাহীম খাঁ ইতিহাসের বিষয়বস্তু থেকে নাটক রচনার প্রেরণা পান। কিন্তু তার পূর্বে সমাজই ছিল নাট্য সাহিত্যের মূল প্রেরণা। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় শেখ আজিমদ্দি, মুন্সী নামদার, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখ লেখকের নক্সা এবং রচনাবলির কথা।
পাকিস্তান আমলে বাংলা নাটক
'৪৭-পরবর্তীকালে নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা একসঙ্গে অনেক সাহিত্যিককে পেয়েছি যাঁরা নাটক রচনায় উৎসাহী হয়েছেন। এঁদের মধ্যে জসীমউদ্দীন (১৯০৩- ১৯৭৬), নুরুল মোমেন (১৯০৮), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), আসকার ইবনে শাইখ (১৯২৫), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫), শওকত ওসমান (১৯১৯-১৯৯৯), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২- ১৯৭১), আব্দুল হক (১৯১৮), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২), আনিস চৌধুরী (১৯২৯), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬), এনামুল হক (১৯৩৭ জন্ম-), কল্যাণ মিত্র (১৯৩৯ জন্ম-), জিয়া হায়দার (১৯৩৬ জন্ম-) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান আমলে রচিত নাটকসমূহের মধ্যে নূরুল মোমেনের 'নেমেসিস' একটি উল্লেখযোগ্য নিরীক্ষামূলক নাটক। স্বল্প ঘটনাময় পরিবেশে একক চরিত্রের দ্বন্দ্বময় ও যন্ত্রণা সঙ্কুল মনোবৈকল্য ও ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে নাট্যকার তাঁর শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। আধুনিক জীবন সমস্যার ইঙ্গিত এতে রয়েছে। 'রূপান্তর' 'আলোছায়া' তার উল্লেখযোগ্য নাটক। 'অগ্নিগিরি' (১৯৫৯), 'রক্তপথ', (১৯৬৩), 'বিদ্রোহী পদ্মা' (১৯৫১), 'এপার-ওপার' (১৯৬১) প্রভৃতি আসকার ইবনে শাইখের উল্লেখযোগ্য নাটক।
কবি জসীমউদ্দীন লোকনাট্য সৃষ্টির মাধ্যমে পল্লী জীবনের চিত্র অঙ্কন করেন। পল্লীর নর নারীর হৃদয়ের কথা, প্রেম-বিরহ মিলনের বাণীর অভিব্যক্তি তাঁর নাটক। 'পদ্মাপার' (১৯৫০), 'বেদের মেয়ে' (১৯৫১), 'মধুমালা' (১৯৫১), পল্লী বধূ' (১৯৫৬) প্রভৃতি জসীমউদ্দিন রচিত নাটক।
' বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক স্মরণীয় ব্যক্তি মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১)। নানা নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি তাঁর নাটকীয় কলাকৌশল সৃষ্টি করেছেন। তিনি বিশেষভাবে পরিবেশ সচেতন শিল্পী। তাঁর প্রথম নাটক 'রক্তাক্ত প্রান্তর' পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে রচিত। তাঁর 'কবর' নাটকটি সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। এখানে তিনি ভাষা আন্দোলনকে অসম সাহসিকতায় চিহ্নিত করেছেন। ঘৃণা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে। সিকান্দার আবু জাফরের উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে 'শকুন্ত উপাখ্যান' (১৯৫৮), 'সিরাজউদ্দৌলা' (১৯৬৫) এবং 'মহাকবি আলাওল' (১৯৬৫)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মূলত ঔপন্যাসিকরূপে পরিচিত হলেও নাট্যাঙ্গনেও তিনি আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। 'বহিপীর' (১৯৬০) ও 'তরঙ্গভঙ্গ' (১৯৬৪) তাঁর দুটি নাটক।
নাটকের শ্রেণীবিভাগ
নাটকের শ্রেণীবিভাগ কোনো বিশেষ বিষয়কে ভিত্তি করে করা হয়নি। নানারকম বিষয়বস্তু অনুসারে নাটককে নানাভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। নাটকের শ্রেণীবিভাগগুলো এরকম—
- বিষয়বস্তুর দিক থেকে নাটক ছয় প্রকার যথাঃ ১. পৌরাণিক ২. ঐতিহাসিক ৩. সামাজিক ৪. পারিবারিক ৫. উপকথাশ্রয়ী ও ৬. কাল্পনিক
- রসের দিক থেকে নাটক দুই প্রকার যথাঃ ১. নাটক ২.প্রহসন
- অভিনয়ের দিক থেকে নাটক দুই প্রকার যথাঃ ১. নাটক ২.যাত্রাপালা
- আয়তন/আকার বা অঙ্কসংখ্যা অনুসারে নাটক চার প্রকার যথাঃ ১. মহানাটক ২. নাটক ৩. নাটিকা ৪. একাঙ্কিকা
- রচনা রীতি অনুসারে নাটক তিন প্রকার যথাঃ ১. পদ্যনাটক ২. গদ্যনাটক ৩. গদ্য-পদ্যময় নাটক
- ইংরেজি আদর্শের দিক থেকে নাটক পাঁচ প্রকার যথাঃ ১. ট্র্যাজেডি ২. কমেডি ৩. মেলোড্রামা ৪. ট্র্যাজি-কমেডি ৫. ফার্স
- ভাবের দিক থেকে নাটক তিন প্রকার যথাঃ ১. ক্লাসিকাল ২. নিও-ক্লাসিক্যাল ৩. রোমান্টিক
প্রকৃতপক্ষে নাটকের শ্রেণীবিভাগের সুনির্দিষ্ট কোন কাঠামো বা ভিত্তি নেই। যে কোন আঙ্গিকেই নাটকের শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের নাটকের শ্রেণীবিভাগ
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গানে নতুন উদ্যম ও গতি পরিলক্ষিত হয়। অনেক নাট্যকার তাদের নাটকে এ সময় মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরতা, স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতি নিয়ে নাটক রচনায় উৎসাহী হন। এছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশি-বিদেশি নাট্যচিন্তার আলোকে নিরীক্ষাধর্মী নাটক রচনা এবং অনুবাদ নাটক মঞ্চায়নের প্রয়াস দেখা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে যে নাট্যধারা সৃষ্টি হয়েছে- তাতে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনা এবং সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরার প্রচেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এছাড়া সমকালীন বাংলা নাটকে ভাষা সংলাপ তথা আঙ্গিকগত দিক থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুনত্ব আনার প্রয়াস দেখা যায়। বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশের নাটককে আমরা প্রধানত পাঁচটি প্রবণতায় বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হলো:
- মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক
- প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমূলক নাটক
- সামাজিক নাটক
- ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক নাটক
- অনুবাদ বা রূপান্তরিত নাটক
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপট নির্মাণে এদেশের সাহিত্য বিশেষত নাটক পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আবার যুদ্ধোত্তরকালে স্বাধীনতার চেতনাকে মর্মমূলে লালন করে আমাদের সাহিত্য তথা নাটকের অঙ্গনও হয়েছে সমৃদ্ধ। নাট্যাঙ্গন উদ্ভাসিত হয়েছে নতুন নতুন মাত্রায়।
স্বাধীনতা উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্মন করে নাটক রচিত হয়েছে। বিগত শতাব্দীর ২৭-২৮ বছর ধরে নিজেকে শনাক্ত করার যে সাধনায় বাংলাদেশের নাট্যকারগণ ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর সাফল্যে নাটকের বিষয় ও প্রকরণে যুদ্ধ পরবর্তীকালে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের নাটকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি প্রকরণ পরিচর্যায়ও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। বাংলাদেশের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে নাটক রচিত হয়েছে। কখনো বা নাটকের বিষয়াংশ সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উজ্জীবন ঘটিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে মমতাজ উদ্দীন আহমদ যে সব নাটক রচনা করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' (রচনাকাল ১৯৭১), 'এবারের সংগ্রাম' (রচনা ১৯৭১), 'স্বাধীনতার সংগ্রাম' (রচনা ১৯৭১) এবং 'বর্ণচোর' (রচনা ১৯৭২) তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চারটি নাটক। এ ছাড়া তিনি কিশোরদের জন্য লিখেছেন 'বকুল পুরের স্বাধীনতা' (১৯৮৬)। 'কি চাহ শঙ্খচিল' নাটকে মমতাজ উদ্দীন নারী ধর্ষণ, যুদ্ধকালে নারীদের অপরিমেয় যন্ত্রণা ও বেদনার ইতিহাস শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন। তুলে ধরেছেন সর্বহারা নারীদের বুক ফাটা আর্তনাদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নারী ধর্ষণের পটে লেখা হয়েছে আরো কিছু নাটক। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: আলাউদ্দিন আল আজাদের 'নিঃশব্দ যাত্রা' (১৯৭২), 'নরকে লাল গোলাপ' (১৯৭৪), জিয়া হায়দারের 'সাদা গোলাপে আগুন' (১৯৮২), নীলিমা ইব্রাহিমের 'যে অরণ্যে আলো নেই' (১৯৭৪) প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে সবচেয়ে সার্থক ও মঞ্চসফল নাটকের রচয়িতা সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫)। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয় তার 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' (১৯৭৬) শীর্ষক কাব্যনাটক। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আসন্ন বিজয়লগ্নে গ্রামে প্রবেশ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। এ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মাতবরের বুকফাটা কান্নায়, তার অপমানিত আর্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে যে সব নাটক রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সাইদ আহমদের 'একদিন প্রতিদিন' (১৯৭৮), রনেশ দাশ গুপ্তের 'ফেরী আসছে,' 'কল্যাণ মিত্রের জল্লাদের দরবার' (১৯৭২) উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমূলক নাটক
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধচেতনা। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণ' (১৮৬০) নাটকের মাধ্যম বাংলা নাটকে যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের অঙ্গীকার করেছিল; শতবর্ষের ব্যবধানে সে প্রতিবাদের ধারাই যেন আরো প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাটকে। প্রাক স্বাধীনতা যুগের মৌসুমি এবং বিনোদনমুখী নাট্যধারার পরিবর্তে বাংলাদেশের সাহিত্যে দেখা দিল বক্তব্যধর্মী সমাজচেতন নাট্যধারা। এ নাট্যস্রোতে যাঁদের অবদান উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন মমতাজ উদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন (১৯৪৩), সেলিম আলদীন (১৯৪৮), মামুনুর রশীদ (১৯৪৮), এস. এম. সোলায়মান, কবি আনোয়ার, রাজীব হুমায়ুন প্রমুখ নাট্যকার।
বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষকে তুলে ধরে সৃষ্টিশীপ নাটক রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন মামুনুর রশিদ । শ্রেণী সংগ্রাম তথা শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই তার নাটকের মুখ্য বিষয়বস্তু। কেবল বাংলাদেশের নাটক নয়, গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই মামুনুর রশিদের এ প্রাতিষ্ঠিক জীবনদর্শন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। 'ওরা কদম আলী' (১৯৭৮) 'ওরা আছে বলেই' (১৯৮০), 'ইবলিশ' (১৯৮২।, 'এখানে নোঙর' (১৯৮৪), 'খোলা দুয়ার' (১৯৮৪), 'গিনিপিগ (১৯৮৬), প্রভৃতি নাটকে অত্যাচারিত মানুষ সামাজিক অসাম্যে সচেতন হয়ে ওঠে।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নাটক রচনায় আবদুল্লাহ আল মামুনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর শপথ' (১৯৭৬) নাটকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর 'সেনাপতি (১৯৮০) ও ' এখনও ক্রীতদাস' (১৯৮৪) নাটকেও আছে সংগ্রাম ও প্রতিরোধের ছবি। সেলিম আল দীনের একাধিক নাটকে চিত্রিত হয়েছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চিত্র। তার 'কিত্তন খোলা' (১৯৮৬) নাটকে ক্রুদ্ধ স্পর্ধিত শোষক' চরিত্রের সঙ্গে সহজ সরল নিরন্ন মানুষের দ্বন্দ্বের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
মমতাজ উদ্দীন আহমদের 'সাত ঘাটের কানাকড়ি' (১৯৯১) নাটকে রয়েছে স্বৈরাচার শাসিত অসহনীয় এক কুৎসিত সময়ের কিছু নষ্ট চরিত্রের সঙ্গে সহজ সরল নির্ভীক মানুষের সংগ্রাম আর সাহস এবং আত্মত্যাগের ইতিকথা। 'সাত ঘাটের কানাকড়ি' বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের এক মূল্যবান সম্পদ। রাজীব হুমায়ুনের 'নীল পানিয়া' (১৯৯২) নাটকেও দেখা যায় সম্মিলিত বাঙালির প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শব্দচিত্র।
সামাজিক নাটক
মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে সমাজের অবক্ষয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতি আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিপথগামিতা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক নাটক। এ ধারায় উল্লেখযোগ্য নাটক রচনা করেছেন বিভিন্ন নাট্যকার। যে সব নাট্যকার সামাজিক নাটক রচনায় বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন তাঁরা হলেন, সৈয়দ শামসুল হক , মমতাজ উদ্দীন আহমদ, বশীর আল হেলাল (১৯৩৬), বুলবুল ওসমান (১৯৪০), রশীদ হায়দার (১৯৪১), আতিকুল হক চৌধুরী, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন আহমেদ, এস. এম. সোলায়মান, আল মনসুর প্রমুখ। এ ধারার উল্লেখযোগ্য নাটক হলো আবদুল্লাহ আল মামুনের 'সুবচন নির্বাসনে' (১৯৭৪), 'আয়নায় বন্ধুর মুখ' (১৯৮৩), 'চারিদিকে যুদ্ধ' (১৯৮৩), 'কোকিলারা' (১৯৯০), সৈয়দ শামসুল হকের 'এখানে এখান' (১৯৮৮), ফলাফল নিম্নচাপ', 'ক্ষত-বিক্ষত' (১৯৮৬)। সেলিম আল দীনের 'মুনতাসীর ফ্যান্টাসী (১৯৮৬), সংবাদ কার্টুন (১৯৮৭)। রশীদ হায়দারের 'তৈল সংকট' (১৯৭৪) প্রভৃতি।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভিত্তিক নাটক
ইতিহাস এবং ঐতিহ্য হতাশাগ্রস্ত একটি জাতিকে দিক নির্দেশনা দিতে পারে সুন্দর ভবিষ্যতের। ১৯৭১ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নাটকের অন্যতম প্রবণতা হলো ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাণের নব মূল্যায়ন প্রচেষ্টা এবং এভাবেই ইতিহাস ঐতিহ্যের কঙ্কালে সমকালকে ধারণ করতে চাইলেন, আমাদের কয়েকজন নাট্যকার। এ ধারায় সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে যাদের কৃতিত্ব স্মরণযোগ্য তাঁরা হলেন, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, সাইদ আহমদ, সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ প্রমুখ।
১৭৮৩ সালের রংপুর-দিনাজপুরের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী কৃষক নেতা নূরুলদীনের সংগ্রাম, সাহস আর সংক্ষোভ নিয়ে 'নূরুলদীনের সারা জীবন'। সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, ১৭৮৩ বা ১৯৫২ কি ১৯৭১-এর ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়, বাঙালি জাতিসত্তার এ সংগ্রামী চেতনা উপস্থাপনের জন্যই তাঁর নূরুলদীনের স্মরণ।
ঐতিহাসিক ঘটনাকে সমকালীন সমাজ বাস্তবতার উপযোগী করে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সাইদ আহমদও বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর 'শেষ নবাব' নাটকে সিরাজউদ্দৌলার শক্তি, সাহস আর দেশপ্রেমকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন সমকালীন মানুষের চিত্তে। ফলে সিরাজউদ্দৌলা তাঁর হাতে উপস্থাপিত হয়েছে নতুন পরিচয়ে, নতুন সত্তায়।
মমতাজ উদ্দীন আহমদ মুক্তি সংগ্রামী স্পার্টাকাসকে রূপকের ব্যঞ্জনায় নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তাঁর 'স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা' (১৯৭৬) নাটকে। ক্রীতদাসদের বীরনেতা স্পার্টাকাসকে নাট্যবিষয় করে মমতাজ উদ্দীন আহমদ তুলে ধরেছেন তাঁর প্রগতি সমাজচেতনার পরিচয়। স্পার্টাকাস, লুলুম্বা, ল্যাটিন আমেরিকা, ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে, এ নাটকে মমতাজ উদ্দীন আহমদ ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ ছাড়া এ ধারার অন্যান্য নাটক হল মামুনুর রশীদের 'লেবেদফ' (১৯৯৫), সেলিম আল দীনের 'শকুন্তলা' (১৯৮৬) প্রভৃতি।
অনূদিত বা রূপান্তরিত নাটক
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনুবাদ ও রূপান্তর ভিত্তিক বিশেষ নাটাধারার সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার পূর্বেও এ প্রবণতা ছিল, আমাদের নাট্যাঙ্গনে। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এ ধারা নতুন প্রাণময়তায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন মুনীর চৌধুরী। তিনি শেক্সপীয়র, বার্নার্ড শ', স্ট্রিন্ডবার্গ প্রমুখ নাট্যকারের নাটক অনুবাদ বা রূপান্তর করেন। এ ছাড়া ৭১-পূর্ববর্তীকালে যাঁরা বিদেশি নাটকের বাংলা রূপান্তর করেন তাঁরা হলেন জিয়া হায়দার, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, কবীর চৌধুরী, শওকত ওসমান, আবদুল হক, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ।
১৯৭১-৯৮ কালপর্বে বাংলাদেশের রূপান্তর নাটকের ধারা আরও বেশি সমৃদ্ধি অর্জন করে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য রূপান্তরিত নাটক হলো সৈয়দ শামসুল হকের 'গণনায়ক' (মূল শেক্সপীয়ের 'জুলিয়াস সিজার'), কবীর চৌধুরীর 'গড়োর প্রতীক্ষায়' (মূল সামুয়েল বেকেট), মমতাজ উদ্দীনের 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' (মূল লেডী গ্রেগরীর 'রাইজিং অব দি মুন'), জিয়া হায়দারের ডক্টর ফস্টাস, মূল ক্রিস্টোফার মালো আসাদুজ্জামান নূরের 'দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা', খোন্দকার আশরাফ হোসেনের 'রাজা ঈদিপাস' (মূল সফোক্লিস) প্রভৃতি।
আঙ্গিক প্রসঙ্গে: ৭১- পরবর্তীকালে বিষয়বস্তুর সঙ্গে আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নাটকে মৌল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সংলাপ সৃষ্টি, আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ, বিশেষ নাট্যমুহূর্ত নির্মাণ, ঐহিত্য ও আধুনিকতার সমন্বয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। আলোচ্য পর্বে যুক্ত হয়েছে ছন্দ, নাটক, কথানাট্য, মুক্ত নাটক, এপিক থিয়েটার প্রভৃতি নাট্য আঙ্গিকসমূহ। আমাদের নতুন প্রজন্মের নাট্যকারদের হাতে এসব ধারা এখন ব্যাপকভাবে অনুসৃত হচ্ছে।