উপন্যাস শব্দটি উপনয় বা উপন্যস্ত শব্দ থেকে ‘উদ্ভুত’ । উপন্যাস বাংলা সাহিত্যতত্ত্বের একটি পারিভাষিক শব্দ । যেটি ইংরেজি Novel শব্দের পরিভাষা হিসেবে বাংলায় গৃহীত হয়েছে। সাধারণ অর্থে উপন্যাস বলতে গদ্যে লিখিত সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার উপস্থাপনাকে বোঝায়। সাধারণত সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ গল্প,কিচ্ছা,কাহিনী এসব শুনতে অভ্যস্ত এবং বেশ আগ্রহের সহিত সেটা শুনতে বা বুঝতে চায় যদি সেটার মধ্যে কোন রহস্য অথবা সামাজিক জীবনের কোন বাস্তব ঘটনাকে ইঙ্গিত করে লেখা হয় বা বলা হয়।গল্প সাধারণত আঙ্গিকে ছোট এবং একটি মাত্র দিকের প্রতিফলন ঘটায় কিন্তু উপনাস আঙ্গিকে বড় এবং বিস্তৃত পটভূমিতে সমগ্র মানবজীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। বাংলা উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কিন্তু সংগঠন ও কাহিনীর বিবেচনায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশেই বাংলা উপন্যাস পরিপক্কতা অর্জন করেছিল। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ জানার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক উপন্যাস কাকে বলে।
প্রাথমিক আলোচনা
উপন্যাস হচ্ছে সমষ্টিবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ মানুষের এমন একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প যেখানে বিচিত্র সব চরিত্র স্বমূর্তিতে অঙ্কিত হয়ে প্রতীকীভাবে জীবনের এক গভীর সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে।লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতিকে বাস্তবকাহিনি অবলম্বনে শিল্পকর্মে রূপায়ণই উপন্যাস। বাংলা উপন্যাস রচনার সূচনা হয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই। যা ছিল সামাজিক কাহিনি নির্ভর। একটি সার্থক উপন্যাসে কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র, উপস্থাপন, রস, সংলাপ বা কথোপকথন, ভাষা, এলাকা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত লেখকের জীবনদর্শন,বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবনানুভূতিই প্রকাশ পায় এবং সেই সাথে প্রকাশ পায় সামাজিক ত্রুটির প্রতি বিশেষ কোন ইঙ্গিত।
কথাসাহিত্য বলতে কি বুঝায়
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে কথাসাহিত্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেয়াটা জরুরি। যেহেতু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কাহিনী শুনতে অভ্যস্ত। কোন একটি গল্প বা কাহিনী মানুষ যখন আগ্রহী হয়ে শুনে বা বুঝতে চায় এবং যদি সেটার সাহিত্যিক মূল্য থাকে তখনই সেটা হয়ে যায় কথা সাহিত্য। অন্য কথায়, কথাসাহিত্য একটি গল্প বা বিষয়বস্তু বর্ণনা করে, যা কেবল একটি গল্পের চেয়ে বড় কিছুকে লক্ষ্য করে। এই প্রয়াসে এটি সামাজিক, রাজনৈতিক বা মানবজীবন সম্পর্কিত বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ে মন্তব্য করে। এই কথা সাহিত্য সৃষ্টি হয় গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে।তাই কথা সাহিত্য বলতে শুধু উপন্যাস ও ছোটগল্পকেই বোঝায় । উপন্যাসে ব্যক্তি জীবনের বৃহত্তর পরিসরের পরিচয় রূপলাভ করে কিন্তু ছোটগল্পে কোনো চরিত্রের একটিমাত্র দিকের প্রতিফলন ঘটে। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এর এই পর্যায়ে আমরা জানব বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব সম্পর্কে।
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কারণ তখনই বাংলা উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্য যখন আধুনিক যুগে এসে গদ্য সাহিত্যের দিকে পা বাড়ায় ঠিক তখনই বাংলা উপন্যাস তৈরির চেষ্টা চলছিল।
আনন্দ সংকর এবং লিলা রায় উল্লেখ করেছেন যে, '১৯শতকের মাঝামাঝি সময় যখন প্রথম উপন্যাস লেখা হয়, এটি আমাদের জন্য নতুন ছিল, এটি লেখার ধরন আমাদের জন্য নতুন ছিল, এটি ভাষার ব্যবহার এবং যে সমাজ ও তার সদস্যদের জন্য লেখা হয়েছিল তারাও নতুন ছিল' (পৃষ্ঠা ১৬৮) ।
প্রথম উপন্যাস রচনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা চালান ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮)। তাঁর রচিত উপন্যাস-
‘কলিকাতা কমলালয়' (১৮২৩) : এ গ্রন্থে তৎকালীন কলকাতার জীবন ও অনাচারের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে কিভাবে কলকাতায় আসতে হয় এবং সেখানকার অলিগলি খুঁজে নিজের ভাগ্যের সন্ধান করতে হয় তারই সত্যকথন ।
‘নববাবু বিলাস' (১৮২৫): এ গ্রন্থে কলকাতার বাবু সমাজের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
‘নববিবি বিলাস' (১৮৩২): এ গ্রন্থে রুচিহীন নীতিভ্রষ্টতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেকালের বড় লোকেরা অনেকেই রক্ষিতা নিয়ে বাইরে রাত্রি যাপন করত। ফলে তাদের স্ত্রীদের যে পদস্খলন ও শোচনীয় পরিণতি হয়েছিল সেটাই এ গ্রন্থের বিষয় ।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত এই গ্রন্থগুলোকে উপন্যাস তৈরির প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা হয়।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে হ্যানা ক্যাথরিন ম্যালেন্স রচিত (অবাঙালি কর্তৃক) ”ফুল মণি ও করুণার বিবরণ” নামীয় গ্রন্থটিকে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাসোম রচনা হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এটিতে উপন্যাসের সকল বৈশিষ্ট্য দেখা যায় নি । বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে বলা যেতে পারে এটি ও উপন্যাস তৈরি দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। এটি The Last Day of the Week নামে ইংরেজি আখ্যানের ছায়াবলম্বনে রচিত। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় ফুলমনির সুখ এবং যথার্থ খ্রিস্ট ধর্মাচরণ না করায় করুণার দুঃখভোগ, পরে মেম সাহেবের ঈশ্বর প্রেরিত সুপরামর্শে করুণার সুমতি ও সুখের মুখদর্শন এ গ্রন্থের মূল কাহিনি। এটি মূলত খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও এতে উপন্যাসের কিছু লক্ষণ দেখা যায়।
পরবর্তীতে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র (বাঙালি কর্তৃক) রচিত “আলালের ঘরের দুলাল” নামীয় আখ্যানে উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যাবলী সুচিহ্নিত হয়েছিল। এজন্য ”আলালের ঘরে দুলাল” কে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বা প্রথম মেীলিক উপন্যাস বলা হয় । কারো মতে, এটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। অর্থাৎ এটি সার্থক উপন্যাস কি না এ নিয়ে বিতর্ক আছে। প্যারীচাঁদ মিত্রকে বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস ধারার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বা প্রথম ঔপন্যাসিক বলা হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় ”আলালের ঘরে দুলাল” উপন্যাসটির বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র ‘টেকচাঁদ ঠাকুর' নামে ১৮৫৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘মাসিক' পত্রিকায় লিখতেন। এটি কথ্য ভাষায় লিখিত যা ‘আলালি ভাষা' নামে পরিচিত।
অতঃপর ইউরোপীয় ভাবধারার অনুকরণে ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এবং প্রকাশিত ”দুর্গেশনন্দিনী” বাংলা ভাষার উপন্যাসের প্রথম প্রামাণিক বা সার্থক উপন্যাসের উদাহরণ।কারণ এতে উপন্যাসের সকল বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে রক্ষিত হয়েছিল। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে উড়িষ্যার অধিকার নিয়ে মোঘল ও পাঠানদের মধ্যে যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, তারই পটভূমিকা এ উপন্যাসের উপজীব্য। দুর্গেশনন্দিনী অর্থ দূর্গ প্রধানের কন্যা। অন্যতম চরিত্র: আয়েশা, তিলোত্তমা।
বাংলা উপন্যাসের ক্রমবিকাশ
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এর এই পর্যায়ে আমরা বাংলা উপন্যাসের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানার চেষ্টা করব। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে দীর্ঘ কাল বাংলা উপন্যাসে ইউরোপীয় উপন্যাসের ভাবধারার প্রচলন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি সাহিত্যের সকল শাখাকেই ঋদ্ধ করেছেন তিনি ও বাংলা উপন্যাসকে নতুন মাত্রা এনে দেন। । যদিও সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে যথেষ্ট রসোত্তীর্ণ মনে করেন না। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর আরেকজন প্রভাবশালী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি উপন্যসের জন্য দেশীয় সমাজ-সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেছিলেন।
১৯৮০’র দশকে হুমায়ূন আহমেদের সবল উপস্থিতিতে বাংলা কথাসাহিত্য আরেক নতুন মাত্রা পায়। অনুভূত হওয়ার আগে বাংলা উপন্যাসের অধিক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিকদের অবদান ছিল সংকীর্ণ । এ সময়কার যে কয়েকজন প্রধান লেখক বাংলা উপন্যাসের সমৃদ্ধ ধারা অব্যাহত রাখেন তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তবে সত্তর দশক পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক কবি জীবনানন্দ দাশের অনন্যসাধারণ উপন্যাসসমূহের অস্তিত্বের খবর। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র লেখক তিনিই যার লেখা সাহিত্য তার মৃত্যুর পরে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ২২টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
বাংলা উপন্যাস আরেকধাপ এগিয়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত ও কমলকুমার মজুমদারের হাত ধরে। এদের হাতে ইউরোপীয় ভাবধারা অথবা উপন্যাস বড় মাপের পরিবর্তে মানবিক অস্তিত্বের নানা দিকের ওপর আলোকপাত করে বিকশিত হয়। বস্তুত রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায় সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস শিল্পী। তারই পথ ধরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিকশিত হতে দেখা যায়। এরা উপন্যাসকে চিত্রায়িত করেছেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক জটিলতার ওপর নিবিড় আলোকপাতের উদ্দেশ্যে। তাদের হাতে উপন্যাসে শিল্পশৈলীতে সঞ্চারিত হয়েছে দৃঢ় গদ্যের সক্ষমতা। মানবীয় ও সামাজিক বিষয়ের বিচিত্র বিবেচনা উপন্যাসকে সাধারণ পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন এবং একই সঙ্গে উপন্যাসের
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা উপন্যাসে সম্পূর্ণ নতুন করণকৌশল নিয়ে আবির্ভূত হলেন বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বাংলা উপন্যাসকে নতুন খাতে প্রবাহিত করলেন। বাঙলা উপন্যাস দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিকদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ একাই শত বর্ষের খামতি পূরণ করে দিলেন। তার উপন্যাসের অবয়ব হলো সবজান্তা লেখকের বর্ণনার পরিবর্তে পাত্র-পাত্রীদের মিথস্ক্রিয়া অর্থাৎ সংলাপকে প্রাধান্য দিয়ে ছোট এবং স্বল্প পরিসরে অনেক কথা বলার পদ্ধতি প্রবর্তন করলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ দেখালেন যে ইউরোপীয় আদলের বাইরেও সফল, রসময় এবং শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস লেখা সম্ভব।
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত কিছু তথ্য
বাংলা উপন্যাস তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে ‘কলিকাতা কমলালয়' ,‘নববাবু বিলাস' ,‘নববিবি বিলাস' ” কে।
ফুল মণি ও করুণার বিবরণ” হল দ্বিতীয় প্রচেষ্টা ।
বাংলা ভাষার প্রথম মেীলিক উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরে দুলাল”।
প্রথম সার্থক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের “দুর্গেশনন্দিনী ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ' (১৮৭৬)।
প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের “কপালকুন্ডলা” ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন । তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘রত্নবর্তী’ (১৮৬৯)।
ত্রয়ী উপন্যাস বলতে মূলত স্বাভাবিক যোগসুত্র ও ধারাবাহিকতায় এক সাথে তিনটি উপন্যাসকে বোঝানো হয়। ইংরেজিতে একে বলে ট্রিলজি। এ তিনটি সিরিজে ধারাবাহিকতা থাকে। আবার প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে পাঠযোগ্য । আবুজাফর শামসুদ্দিনের ত্রয়ী উপন্যাস হল ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান ( ১৯৬৩ ) , পদ্মা মেঘনা যমুনা ( ১৯৭৪ ) , সংকর সংকীর্তন ( ১৯৮০ ) । বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের এরুপ ত্রয়ী উপন্যাস হলো___ আনন্দমঠ (১৮৮৪), দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪) এবং সীতারাম (১৮৮৭)।
বাংলা উপন্যাসের শ্রেণীবিভাগ
এতক্ষণ আমরা বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানলাম। এই আর্টিকেলে উপন্যাসের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে ও আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। তাই নিচে বাংলা উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হল।
সাহিত্যিক মূল্য আবার কি তা আগে একটু জেনে নেই। কোন সাহিত্যের ভাব, ভাষা,,রস,সংলাপ,ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয় দিয়ে যখন কোন একটি সাহিত্যকে পরিমাপ করার চেষ্টা করা হয় এটি কি বিষয়ে বা কোন ধরনের সাহিত্য? কিন্তু সাহিত্যিক বিচারে এই সমস্ত মাপকাঠিই সব নয়। সবচেয়ে বড়ো মাপ কাঠি পাঠকের অনুভূতি। যদি সেই অনুভূতিতে কোনো সাহিত্যিক নাড়া দিতে সক্ষম হয় তবে তার ভাষা ছন্দ অলঙ্কার প্রয়োগের অসম্পূর্ণতা থাকলেও তা-ই সত্যিকার সাহিত্য ।
বিষয়বস্তু ,সাহিত্যিক মূল্য ও শিল্পচেতনা অনুযায়ী বাংলা উপন্যাসকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন:
১. ঐতিহাসিক উপন্যাস
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এটা কি ধরনের উপন্যাস? কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন কোন গদ্য ভিত্তিক সাহিত্য বৃহত্তর পরিসরে রচিত হয় সেটাই ঐতিহাসিক উপন্যাস।তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস মনগড়া লেখার মত নয়। রচনার সময় ঔপন্যাসিককে অতীত জীবনের ইতিহাস, রীতি-নীতি, সংস্কার, সামাজিক ও গার্হস্থ্যজীবনের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়। চরিত্র,সংলাপ,ভাষা ইত্যাদি পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু সমসাময়িক কালের ভাবধারা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।ঐতিহাসিক উপন্যাসে সমসাময়িক কালের সংস্কৃতি এবং ভাবধারা অপরিবর্তিত রাখতে হয়। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ, রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বৌঠাকুরাণীর হাট, সত্যেন সেনের আলবেরুণী ইত্যাদি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস।
২. সামাজিক উপন্যাস
সামাজিক উপন্যাস উপন্যাসের একটি বিশেষ শ্রেণী। এই শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে উনিশ শতকে। সামাজিক উপন্যাসগুলিতে সমাজের নানা অন্যায়-অবিচার, কুপ্রথা প্রভৃতির উদ্ঘাটন এবং তাদের সমালোচনার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করা হয়। সহজ কথায় এ ধরনের উপন্যাসে প্রধানত সমাজজীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়। সমাজের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা,প্রতিবন্ধকতা,সামাজিক কুসংস্কারসমূহ এতে প্রধান হয়ে ওঠে এবং এই সব সামাজিক সমস্যাসমূহ কাটিয়ে উঠার ও একটা ইঙ্গিত প্রদান করা হয় উপন্যাসের বিশেষ চরিত্রের মাধ্যমে। বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল; শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, পল্লীসমাজ; রমেশচন্দ্রের সংসার, সমাজ; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) লালসালু (১৯৪৮); শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জননী (১৯৬১) ইত্যাদি এ শ্রেণিভুক্ত উপন্যাস।
৩. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের প্রধান আশ্রয় পাত্র-পাত্রীর মনোজগতের ঘাত-সংঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; চরিত্রের অন্তর্জগতের জটিল রহস্য উদ্ঘাটনই ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য। আবার সামাজিক উপন্যাস ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে নৈকট্যও লক্ষ করা যায়। সামাজিক উপন্যাসে যেমন মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসেও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে কাহিনি অবলম্বন মাত্র, প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে মানবমনের জটিল দিকগুলো সার্থক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, ‘চতুরঙ্গ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাদের অমাবস্যা’ ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের উজ্জ্বল উদাহরণ।
৪. আঞ্চলিক উপন্যাস
এ উপন্যাসে কাহিনী ও চরিত্রাবলি একটি বিশেষ অঞ্চলের পটভূমিতে রচনা হয়। আঞলিক জীবনমান এবং সামাজিক চিত্রই তুলে ধরাই এ্ উপন্যাসের মুখ্য উদ্দেশ্য। কোনো কোনো আঞ্চলিক উপন্যাস অনেক সময় আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) পদ্মা নদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) তিতাস একটি নদীর নাম ইত্যাদি এ ধরনের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
৫. আত্মজৈবনিক উপন্যাস
ঔপন্যাসিক তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত যখন আন্তরিক ও নিষ্ঠার সহিত শৈল্পিক চেতনায় উপন্যাসে রূপদান করেন তখন তাকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে লেখকের নানা অন্তর্নিহিত ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। উল্লেখ করেন তার ব্যক্তি জীবনের নানা অন্তর্ময় বৈশিষ্টমণ্ডিত ঘটনাসূত্র। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এ ধরনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।
৬. হাস্যরসাত্মক উপন্যাস
এ ধরনের উপন্যাসে লেখক সামাজিকজীবনের যে-কোনো একটি ত্রুটিকে বিষয়বস্ত্ত করে হাস্যরসপূর্ণ চরিত্র সৃষ্টি করেন। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্পতরু; ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) কঙ্কাবতী, ফোকলা দিগম্বর; চন্দ্রনাথ বসুর পশুপতি সম্বাদ; কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোষ্ঠীর ফলাফল ইত্যাদি এ শ্রেণির উপন্যাস।
৭. রহস্য উপন্যাস
রহস্যোপন্যাসে ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য থাকে যে কোন একটি রহস্য তৈরি করা এবং উপন্যাস শেষ পর্যন্ত তা ধীরে ধীরে উন্মোচন করা। এ জাতীয় উপন্যাসে রহস্য উদঘাটনের জন্য পাঠক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকে। দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, কাজী আনোয়ার হোসেন প্রমুখ লেখক বাংলা ভাষায় বহু রহস্যোপন্যাস লিখেছেন। ফেলুদা সিরিজ, কিরীটী অমনিবাস, মাসুদ রানা সিরিজ, কুয়াশা সিরিজ প্রভৃতি এ জাতীয় উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।
৮. গোয়েন্দা উপন্যাস
অপরাধ ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৫৫-১৯০৭) দারোগার দপ্তর, বনফুলের পঞ্চপর্ব, শরচ্চন্দ্র সরকারের গোয়েন্দাকাহিনী, অম্বিকাচারণ গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এবং ক্ষেত্রঘোষের আদরিণী এ শ্রেণির উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তবে বাংলা গোয়েন্দা উপন্যাসের সবচাইতে স্বার্থক উদাহরণ হল সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী ও কম জনপ্রিয় নয়!এছাড়াও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সজারুর কাঁটা।
৯. কাব্যধর্মী উপন্যাস
এতে লেখকের জীবনদর্শন ও গীতিধর্মিতা প্রাধান্য পায়। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা এ জাতীয় একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
১০. পত্রোপন্যাস উপন্যাস
এ ধরনের উপন্যাসকে পত্র আকারে উপস্থাপন করা হয় বলে একে পত্রোপন্যাস উপন্যাস বলে। যেমন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের (১৯০১-১৯৭৬) ক্রৌঞ্চমিথুন, বুদ্ধদেব গুহর সবিনয় নিবেদন ইত্যাদি।
১১. রূপক উপন্যাস
সাহিত্যের রূপকাশ্রয় কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে কখনো কখনো উপন্যাসিক তার রচনায় উপস্থাপিত কাহিনি কাঠামোর অন্তরালে কোনো বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী রূপকাশ্রয়ী বক্তব্যের সাহায্যে উপন্যাসের শিল্পরূপ দান করেন। এ ধরনের উপন্যাসকে রূপক উপন্যাস বলা হয়। রূপক উপন্যাস সৃষ্টিতে শওকত ওসমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘সমাগম’ ‘রাজা উপাখ্যান’, ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ রূপক উপন্যাসের সার্থক দৃষ্টান্ত।
১২. রোমান্সধর্মী উপন্যাস
রোমান্স বলতে বোঝায় বীরত্বপূর্ণ এক ধরনের অবাস্তব কাল্পনিক উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষাযুক্ত কাহিনী । তবে বর্তমানে রোমান্স বলতে বোঝায় বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কল্পনাময় মানবিক কাহিনীকে। এতে কল্পনাভিসারী মন ও অতীতপ্রীতির কথা বেশি ফুটে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা, মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর এ ধরনের উপন্যাস।
১৩. চৈতন্যমূলক উপন্যাস
এ ধরনের উপন্যাসে লেখক মানুষের ব্যক্তিচৈতন্যের গভীরে নিমজ্জিত নানা বিষয়ের আংশিক আভাস দিয়ে থাকেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে এরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
১৪. পুরাণ কাহিনীমূলক উপন্যাস
পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। কাহিনীই এ ধরনের উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। এ ক্ষেত্রে দীনেশ সেনের শ্যামল ও কজ্জল, জড়ভরত ও বেহুলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৫. বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস
বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। মণীন্দ্রলাল বসুর অজয়কুমার এ শ্রেণিভুক্ত উপন্যাস। এ ছাড়া রূপক-প্রতীকী উপন্যাস এবং অস্তিত্ববাদী উপন্যাস আধুনিক উপন্যাস সাহিত্যের নতুন সংযোজন।
পরিশেষে, বাংলা উপন্যাস বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের একটি পরিণত রুপ। একটা সময় ছিল যখন সাহিত্য বলতে শুধু কবিতাকেই বুঝাত। কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ ছাড়া সাহিত্যিক রচনার কোন মূল্য ছিল না পাঠকের কাছে। আজকের বাংলা উপন্যাস পাঠকের মনে যথেষ্ট সাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সৃজনশীল এবং সৃষ্টিশীল মানুষদের হাত ধরে ক্রমেই সমৃদ্ধ হচ্ছে সাহিত্যের এ শাখা। আশা করছি আমি ও বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে অল্প বিস্তর ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি। এই পর্যন্ত আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার জন্য আরো : বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এবং শ্রেণীবিভাগ বিখ্যাত বাংলা উপন্যাস