খাঁটি বাংলা বা বিদেশি শব্দে মূর্ধ্যন্য ধ্বনির ব্যবহার নাই বললেই চলে । সেজন্য খাঁটি বাংলা বা দেশি-বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য বর্ণ লেখার প্রয়োজন হয় না। তবে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দে মূর্ধ্যন্য বর্ণের প্রয়োজন হয়। কারণ তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় অবিকৃত ভাবে ব্যবহৃত হয়। তৎসম শব্দে বানান ও তার উচ্চারণ রীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার যে সব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে, সে সব শব্দে সংস্কৃত ভাষার বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে। এসব শব্দের জন্যই বাংলা ব্যাকরণে ণ-ত্ব বিধান ও ষ-ত্ব বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
ণ-ত্ব বিধান
বাংলা (দেশি), তদ্ভব ও বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য বর্ণ লেখার প্রয়োজন হয় না। এক কথায় বাংলা ভাষায় ণ-ত্ব বিধানের প্রয়োজন হত না। যদি বাংলা ভাষার কিছু শব্দ সংস্কৃত থেকে আমদানি করা না হত। তাই যে নিয়ম অনুসারে তৎসম শব্দে ‘ণ’ এর ব্যবহার এবং অতৎসম শব্দে ‘ন’ এর ব্যবহার হয় তাকে ণ-ত্ব বিধান বলে।
ণ-ব্যবহারের নিয়ম
- তৎসম শব্দে ঋ, র, ষ বর্ণের পরে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: ঋণ,তৃণ,বর্ণ,বর্ণনা,কারণ,ব্যাকরণ,বিকিরণ,মরণ, সমীরণ,ভাষণ,উষ্ণ ইত্যাদি।
- ট-বর্গীয় ধ্বনির (ট, ঠ, ড, ঢ) পূর্বে তৎসম শব্দে সবসময় মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন:ঘণ্টা (ণ্ট = ণ্ + ট),বণ্টন,লুণ্ঠন,খণ্ড (ণ্ড = ণ্ + ড) ইত্যাদি।
- যদি ঋ, র, ষ বর্ণের পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য, ব, হ, য় অথবা অনুস্বার (ং) থাকে, তার পরে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন:কৃপণ (ঋ কারের পরে প, তার পরে ণ),নির্বাণ,লক্ষণ,গ্রহণ ইত্যাদি।
- প্র, পরা, পরি, নির – এ চারটি উপসর্গের পর স্বরবর্ণ থাকলে কৃৎ প্রত্যয়ে ণ-হয়।যেমন: পরিণত,প্রণাম, প্রমাণ, প্রণীত, নির্ণয় ইত্যাদি।
- কতগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: (ছন্দ আকারে)
চাণক্য মাণিক্য গণ বাণিজ্য লবণ মণ
বেণু বীণা কঙ্কণ কণিকা।
কল্যাণ শোণিত মণি স্থাণু গুণ পুণ্য বেণী
ফণী অণু বিপণি গণিকা।
আপণ লাবণ্য বাণী নিপুণ ভণিতা পাণি
গৌণ কোণ ভাণ পণ শাণ।
চিক্কণ নিক্কণ তূণ কফণি (কনুই) বণিক গুণ
গণনা পিণাক পণ্য বাণ।
এখানে শোণিত অর্থ রক্ত, স্থাণু অর্থ স্থির/নিশ্চল, বিপণি অর্থ বিক্রয়কেন্দ্র, গণিকা অর্থ যৌনকর্ম করে যারা, আপণ অর্থ দোকান, পাণি অর্থ হাত, ভাণ অর্থ সংস্কৃত নাটকবিশেষ, চিক্কণ অর্থ সুপারি গাছ বা স্নিগ্ধ/মসৃণ, নিক্কণ অর্থ ধ্বনি/শব্দ, তূণ অর্থ যাতে বাণ রাখা হয় বা নিষঙ্গ, পিণাক অর্থ ত্রিশূল।
যে সব ক্ষেত্রে ণ-ত্ব বিধান খাটে না
- ত-বর্গযুক্ত বানানে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: বৃন্ত, যন্ত্র,মন্ত্র,বৃন্দ, গ্রন্থ ইত্যাদি। এখানে লক্ষ্য করুন ত,ত,ত,দ এবং থ “ন” এর সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে “ন” ব্যবহার করা হয়েছে।
- বাংলা ক্রিয়াপদের বানানে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: ধরেন , মারেন,কাটেন, করেন, যাবেন, খাবেন, হবেন, নিবেন, দিবেন।অর্থাৎ যত বাংলা ক্রিয়াপদ আছে সব ক্ষেত্রেই ‘ন’ ব্যবহার করা হয়।
- বিদেশী শব্দের বানানে ও দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: কোরআন, জার্মান, জবান, নিশান, ফরমান, রিপন।
ষ-ত্ব বিধান
বাংলা (দেশি), তদ্ভব ও বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য বর্ণ লেখার প্রয়োজন হয় না। এক কথায় বাংলা ভাষায় ষ-ত্ব বিধানের প্রয়োজন হত না। যদি বাংলা ভাষার কিছু শব্দ সংস্কৃত থেকে আমদানি করা না হত। তাই যে নিয়ম অনুসারে তৎসম শব্দে ‘ষ’ এর ব্যবহার এবং অতৎসম শব্দে ‘স’ এর ব্যবহার হয় তাকে ষ-ত্ব বিধান বলে।
ষ-ব্যবহারের নিয়ম
- ঋ,ঋ-কার ও রেফ এর পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন:ঋষি,কৃষক, বর্ষা,শীর্ষ,আকর্ষণ ,বর্ষণ, বৃষ্টি,তৃষ্ণা ইত্যাদি।
- ট ও ঠ বর্ণের সঙ্গে যুক্তবর্ণ থাকলে ষ হয়। যেমন: দৃষ্টি,অষ্টম,কষ্ট,স্পষ্ট, ষষ্ঠ ইত্যাদি।
- র-ধ্বনির পরে যদি অ, আ ভিন্ন অন্য স্বরধ্বনি থাকে তবে তার পরে ‘ষ’ হয়। যেমন: পরিষ্কার, আবিষ্কার। কিন্তু অ,আ থাকলে স হয়। যেমন: পুরস্কার।
- অ, আ বাদে অন্য স্বরধ্বনি, ক ও র- এর পরের প্রত্যয়াদির দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: ভবিষ্যৎ (ভ + অ + ব + ই + ষ + …) ,পরিষ্কার, আবিষ্কার,মুমূর্ষু,চিকির্ষা (চ + ই + ক + ই + র্ + ষ +…)
- ই-কারান্ত এবং উ-কারান্ত উপসর্গের পর কতকগুলো ধাতুতে ‘ষ’ হয়।যেমন,অভিষেক,সুষুপ্ত,অনুষঙ্গ,বিষম,অনুষ্ঠান,প্রতিষেধক,প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
- কতকগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-‘ষ’ হয়। যেমন-
আষাঢ় শেষ ঈষৎ মেষ
ভাষা কলুষ ভাষ্য মানুষ।
ষোড়শ কোষ পৌষ রোষ
ষট্ পুরুষ মানুষ পাষন্ড ষন্ড প্রত্যূষ।
আভাষ ভাষণ অভিলাষ পোষণ
ঊষর তোষণ ঊষা শোষণ।
ঔষধ বিষাণ ষড়যন্ত্র পাষাণ
বিশেষ ভূষণ সরিয়া দূষণ
যে সব ক্ষেত্রে ষ-ত্ব বিধান খাটে না
- সাৎ প্রত্যয়যুক্ত সকল বানানে “ষ” এর পরিবর্তে “স” ব্যবহার হবে। দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন:ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ, অকস্মাৎ ইত্যাদি।
- খাঁটি বাংলা ও বিদেশী শব্দের বানানে মূর্ধন্য-”ষ” এর পরিবর্তে “স” এবং “শ” এর ব্যবহার করা হয়। যেমন: পুলিশ, জিনিস, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা ইত্যাদি।
- অঃ ( অ বিসর্গ) বা আঃ ( আ বিসর্গ) থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ সন্ধিযুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় দন্ত্য-স হয়। যেমন: পুরঃ + কার = পুরস্কার,ভাঃ+ কর = ভাস্কর, তিরঃ + কার = তিরস্কার, পরঃ+ পর= পরস্পর, স্বতঃ + ফূর্ত= স্বতঃস্ফূর্ত ইত্যাদি
ণ-ত্ব বিধান ও ষ-ত্ব বিধান মনে রাখার টেকনিক
প্রথমে বুঝতে হবে মূর্ধন্য এবং দন্ত বর্ণ কোনগুলো? যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করতে গিয়ে জিহবার অগ্রভাগ দাঁতকে স্পর্শ করে তাহলে সেগুলো হল দন্ত ধ্বনি। কারণ দন্ত শব্দের অর্থ দাঁত। ত বর্গীয় ধ্বনিগুলো ( যেমন ত.থ,দ,ধ) দন্ত ধ্বনি । এখনি উচ্চারণ করে ফেলুন এই ধ্বনিগুলো। দেখুন এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় জিহবার আগা দাঁতকে স্পর্শ করছে কি না? এখন এই দন্ত ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় যদি আরেকটি “ন” অথবা “স” এর উচ্চারণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে সেই ধ্বনিগুলো দন্ত থেকেই উচ্চারণ করা সহজসাধ্য। অর্থাৎ এখানে “ন” এবং “স” ব্যবহার করতে হবে।একই নিয়ম অনুসারে, যেসব ধ্বনি উচ্চারণ করতে গিয়ে জিহবার অগ্রভাগ মূর্ধাকে স্পর্শ করে তাহলে সেগুলো হল মূর্ধন্য ধ্বনি । মূর্ধা হল 'ট'-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ট, ঠ, ড, ঢ) উচ্চারণের সময় জিহবার অগ্রভাগ যেখানে স্পর্শ করে ( জিহবার আগা দাঁতের পাটির ভিতরের উপরের অংশ স্পর্শ করে) ।কাজেই 'ট'-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ট, ঠ, ড, ঢ) হল মূর্ধন্য ধ্বনি । এখনি উচ্চারণ করে ফেলুন এই ধ্বনিগুলো। দেখুন এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় জিহবার আগা দাঁতের পাটির ভিতরের উপরের অংশ স্পর্শ করছে কি না? এখন এই মূর্ধন্য ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় যদি আরেকটি “ন” অথবা “স” এর উচ্চারণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে সেই ধ্বনিগুলো মূর্ধা থেকেই উচ্চারণ করা সহজসাধ্য। অর্থাৎ এখানে “ণ” এবং “ষ” ব্যবহার করতে হবে।
ণ-ত্ব বিধান ও ষ-ত্ব বিধান-এর প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের বানান সঠিক ও নির্ভুল রাখার জন্য ণ-ত্ব বিধান ও ষ-ত্ব বিধান-এর প্রয়োজনীয়ত অনস্বীকার্য। আপনি যদি এই বিধানটি ভালভাবে জানেন তাহলে বাংলা বানানের জন্য আপনি একধাপ এগিয়ে থাকলেন। কারণ বাংলা বানানের নিয়ম কোন একক বিধান থেকে গড়ে ওঠে নি। এর কারণ হল বাংলা ভাষা বিভিন্ন শব্দ অন্য ভাষা থেকে ধার করেছে বা মিশ্রিত হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার ফলে। যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার এই টপিকটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাংলা বানান থেকে প্রশ্ন আসে না এমন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ( তা হোক চাকরির পরীক্ষা বা একাডেমিক কিংবা ভর্তি পরীক্ষা ) নেই বললেই চলে। অত্যন্ত পক্ষে প্রথম একটি করে নিয়ম জানান থাকলে ও আপনি অনেক বানানই শুদ্ধভাবে শিখতে পারবেন আর প্রথম একটি করে নিয়মই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।